কাশীর নবরাত্রি দর্শন
বছরে চারবার আমাদের মাঝে পূজিতা হন মা দুর্গা। চৈত্রে, আষাঢ়ে, শরতে এবং পৌষ মাসে দুর্গাবন্দনা হয়। আদি দুর্গাপুজো কিন্তু চৈত্র মাসে, যা বাসন্তী পুজো নামে আমাদের কাছে পরিচিত। বঙ্গদেশে যেমন শরৎকালের দুর্গাপুজো বিখ্যাত, তেমনই হিন্দি বলয়ে চৈত্র মাসে বাসন্তি নবরাত্রি সাড়ম্বরে পালিত হয়ে আসছে। কাশীতে নবদুর্গা পূজার চল আছে। চৈত্র মাসে মা ভবানির মন্দির গুলো ভরে থাকে ভক্তে তেমনই প্রায় প্রতি বাড়িতে ঘট পূজা হয়।
দেবী দুর্গার আরাধনায় শ্রীরাম চন্দ্রের নামের আগে রাজা সুরথের নাম উল্লেখ রয়েছে। যোদ্ধা হিসাবে রাজা সুরথ ছিলেন খুব দক্ষ। কোন যুদ্ধে নাকি তিনি কখনও হেরে যাননি একদিন প্রতিবেশী রাজ্য তাকে আক্রমণ করলে তিনি পরাজিত হন, এই সুযোগে তার সভাসদরা লুঠপাঠ চালায়। নিজের কাছের লোকেদের এমন আচারনে তিনি অবাক হয়ে যান।
এই সময় তিনি ঘুরতে ঘুরতে ঋষি মেধসের আশ্রমে পৌঁছান। ঋষি তাকে সেখানেই থাকতে বলেন। কিন্তু রাজা মনের শান্তি পান না। এর মধ্যে একদিন তার সঙ্গে সমাধি বলে একজনের দেখা হয়। তিনি জানতে পারেন সমাধিকে তার স্ত্রী ও ছেলে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে, তবুও তিনি বউ ছেলের ভালো-মন্দ এখনও ভেবে চলেছেন।
তারা দুজনেই বিস্মিত হলেন যে, যাদের কারণে তারা আজ সব হারিয়েছে, এখনও তারা তাদের ভালো চেয়ে যাচ্ছেন। ঋষিকে এ কথা জানানোতে তিনি বলেন যে এসবই মহামায়ার ইচ্ছা। এরপর ঋষি মহামায়ার কাহিনী বর্ণনা করেন। ঋষির পরামর্শ মতই রাজা কঠিন তপস্যা শুরু করে। পরে মহামায়ার আশীর্বাদ পেতেই রাজা বসন্তকালের শুক্লপক্ষে দেবী দুর্গার পুজো শুরু করে সেই সময় থেকে শুরু হয়েছিল বাসন্তী পুজো।
আষাঢ় ও পৌষ মাসের দুর্গাপূজাকে গুপ্ত নবরাত্রি বা গুপ্ত দুর্গাপূজা বলা হয়। যারা তন্ত্রসাধনা করেন, তাঁদের জন্য গুপ্ত নবরাত্রি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। কারণ দশ মহাবিদ্যার পুজো করলে শীঘ্রই বিশেষ শক্তি অর্জন করা যায়। বিশ্বাস অনুসারে, আষাঢ় গুপ্ত নবরাত্রির সময়, যে ভক্ত নিয়ম-বিধি অনুসরণ মেনে উপবাস করেন এবং নয় দিনই মা দুর্গার নবরূপের পুজো করেন, মা অম্বের কৃপায় তার সমস্ত ইচ্ছা পূরণ হয়।
প্রথমাং শৈলপুত্রীতি দ্বিতীয়ং ব্রহ্মচারিণী। তৃতীয়ং চন্দ্রঘণ্টেতি কুষ্মাণ্ডেতি চতুর্থকম্।
পঞ্চমং স্কন্দমাতেতি, ষষ্ঠং কাত্যায়নী তথা। সপ্তমং কালরাত্রীতি মহাগৌরিতি চাষ্টমম্। নবমং সিদ্ধিদাত্রী চ নবদুর্গা প্রকীৰ্ত্তিতাঃ।
চলতি বছরে চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের প্রতিপদ তিথি পড়ছে ৮ এপ্রিল বেলা ২টো ১১ মিনিট থেকে। কিন্তু উদয়া তিথি মেনে নবরাত্রির ঘট স্থাপন হবে ৯ এপ্রিল। সেই হিসেবে ২০২৪ সালে ৯ এপ্রিল থেকেই শুরু হয়েছে চৈত্র নবরাত্রি। নবরাত্রির অবসান হবে ১৭ এপ্রিল। পুরো ৯ দিন ধরে চলবে চৈত্র নবরাত্রি পালন। এই নয় দিন কাশীর দুর্গা মন্দিরে পা ধারণের জায়গা থাকবে না।
প্রথম দিনে দেবী শৈলপুত্রী পুজিতা হন। শৈলপুত্রী হলেন দেবী আদি পরাশক্তি। শৈলপুত্রী কথার আক্ষরিক অর্থ হল পর্বতের কন্যা (শৈল)। এছাড়াও তিনি সতী, ভবানী, পার্বতী ইত্যাদি নামে পরিচিত। পর্বতরাজ হিমবত -এর পুত্রী হিসাবে তাকে হেমাবতী নামেও সম্বোধিত করা হয়।
শৈলপুত্রী ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিবের শক্তির প্রতীক। তিনি তার বাহন ষাঁড়ের উপর বিরাজমান থাকেন এবং তার দুই হস্তে একটি ত্রিশূল এবং একটি পদ্ম থাকে। শিব পুরাণ এবং দেবীভাগবত পুরাণ-এর মতো কিছু ধর্মগ্রন্থে দেবীর কাহিনী বর্ননা আছে। পূর্বজন্মে তিনি ছিলেন দক্ষরাজের কন্যা সতী। পিতার অমতে তিনি শিবকে বিবাহ করেছিলেন। একবার দক্ষ এক বড় যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। সেখানে তিনি শিবকে আমন্ত্রণ জানাননি। কিন্তু সতী বিনা আমন্ত্রনে সেখানে পৌঁছে যান। তার সম্মুখে দক্ষ শিবকে অপমান করেন এবং সতী স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে যজ্ঞের আগুনে নিজেকে ভস্মীভুত করে প্রাণত্যাগ করেন। পরজন্মে, তিনি পার্বতী নামে হিমালয়ের কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করেন এবং শিবকে পুনরায় বিবাহ করেন। উপনিষদ অনুসারে তিনি ইন্দ্র প্রভৃতি দেবতাদের অহংকার খন্ডন করেছিলেন এবং লজ্জিত দেবতারা দেবীর কাছে মাথা নত করে প্রার্থনা করেন এবং স্বীকার করেন, "আসলে তুমিই শক্তি; ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিব তোমার শক্তিতেই শক্তিমান।"
শৈলপুত্রী মূলচক্র বা মুলধার চক্রের দেবী হিসাবে পরিচিত। নবরাত্রি পূজায় প্রথম দিন যাতে যোগীরা তাদের মনকে মুলধারায় নিবদ্ধ রাখতে পারেন, তাই সেদিন দেবী শৈলপুত্রীর উপাসনা করা হয়। এটি তাদের আধ্যাত্মিক অনুশাসনের সূচনা বিন্দু। এখান থেকেই তাদের যোগসাধনা শুরু হয়। শৈলপুত্রী হল মূলাধার শক্তি যা নিজের মধ্যে উপলব্ধি করা যায় এবং এর মাধ্যমে যোগ ও ধ্যানে উচ্চতর গভীরতা লাভের জন্য আত্মানুসন্ধান শুরু হয়। এটি আধ্যাত্মিক অবস্থানের প্রতীক। সমগ্র বিশ্ব ও পূর্ণ প্রকৃতি দেবী দুর্গার শৈলপুত্রী রূপ থেকেই শক্তি পায়।
যোগিক দৃষ্টিকোণ থেকে নবরাত্রি প্রথম দিবস অত্যন্ত শুভ দিন বলে বিবেচনা করা হয়। এই দিন থেকে মা দুর্গার সাধনায় রত যোগীদের সাধনপথে ব্রতী হওয়ার সূচনা হয়। যারা শক্তি মন্ত্রে যে কোন প্রকার দীক্ষা নিতে চান তারা সাধারনত শুক্ল পক্ষের প্রতিপদ তিথিতে দীক্ষা নেন।
শৈলপুত্রী পার্থিব অস্তিত্বের সারাংশ। তার আবাস মুলধারা চক্রে। এই শক্তির তত্ত্ব (উপাদান) হল পৃথিবী, যার নিজস্ব গুণ, ঘ্রান (গন্ধ) ও ভেদা (স্বতন্ত্র) ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
উপনিষদের কথায় কাশী যে দুই নদির সিমানার মাঝে তারই একটি বরুণা। মা শৈলপুত্রী দেবীর মন্দির বরুণা নদীর ধারে, ছোটো লালরঙের। প্রধান প্রবেশ পথের ধারে একটা বাঁধানো কুণ্ড। মন্দির প্রাঙ্গণে প্রধান মন্দির ছাড়াও তিনটি ছোটো হনুমান ও শিব মন্দির রয়েছে। প্রধান মন্দির প্রায় ছয় ফুট বর্গাকার পাথরের তৈরি। পূর্ব, উত্তর এবং দক্ষিণে খোলা দরজা, পশ্চিমে বন্ধ। সেই দিকে দেবীর প্রতিমা। এদেশীয় নিয়ম মতে ধাতুর নির্মিত মুখ বা মুখা এবং কাপড় পরানো। দেবীর ধ্যানে বলা হয়েছে— চন্দ্রার্থকৃতশেখরাম্। /বৃষারূঢ়াং শূলধরাং শৈলপুত্রীং যশস্বিনীম্।।'
স্কন্দ পুরাণে বর্ণিত এবং একটি বিশ্বাস অনুসারে, যখন ভগবান শিব বাস করার জন্য কাশীতে আবির্ভূত হন, তখন দেবী গৌরীও তাঁর ভক্তদের আশীর্বাদ করতে কাশীতে আসেন। সেই থেকে, দেবী মুখনির্মালিকা গৌরী কাশীতে অবস্থান করার সময় তার ভক্তদের আশীর্বাদ করেন। নবরাত্রির প্রথম দিনে (প্রতিপদ) প্রচুর সংখ্যক ভক্ত কাশীতে আসেন মুখনির্মালিকা গৌরী দেবীর পূজা করতে। মুখনির্মালিকা গৌরীর আরাধনাকারী ভক্তরা জীবনে সব ধরনের সুখ-সমৃদ্ধি পাবেন বলে বিশ্বাস করে। কাশীতে এই দেবী মন্দির গায় ঘাটে। ঠিকানা, মুখনির্মালিকা গৌরী মন্দির, হনুমানজি মন্দির প্রাঙ্গনে, গাই ঘাট। চৈত্র নবরাত্রির প্রথম দিনে ভক্তরা এই মন্দিরে বিধি সম্মতে পুজা অর্চনা করে থেকেন।
নবদুর্গার দ্বিতীয় রূপ দেবী ব্রহ্মচারিণী। ব্রহ্ম হল তপস্যার একটি স্তর। ব্রহ্মচারিণী সেই অর্থে তপস্যাকারী বা তপশ্চারিণী। তার বাসস্থান স্বাধিষ্ঠান চক্রে। ‘ব্রহ্মচারিণী’ নামের অর্থ ‘ব্রহ্মচর্য ব্রত অবলম্বনকারিণী’ বা পালনকারিণী। দেবীর রূপ বলতে, তিনি দ্বিভুজা কিন্তু, ত্রিনয়নী। তাঁর পরনে সাদা শাড়ি ও ফুলের অলঙ্কার। এক হাতে কমণ্ডলু। দেবীর অন্য হাতে জপমালা। তন্ত্রমতে দেবী ব্রহ্মচারিণী ব্রহ্মের প্রতিনিধি রূপে দেবতাদের দর্পও চূর্ণ করেছিলেন। দেবীর ভৈরবের নাম চন্দ্রমৌলীশ্বর। দেবীপুরাণ অনুযায়ী, তিনি সর্ববেদে বিচরণ করেন। আর, সেই কারণেই দেবী পার্বতীরই অপর নাম ‘ব্রহ্মচারিণী’।
এক সময় স্বর্গে তর্কসুর অসুরের দাপট, যাকে কেবল শিবের সন্তানই হত্যা করতে পারে।এদিকে কুমারী পার্বতী শিবকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে । তার বাবা-মা তাকে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করে, কিন্তু সে অবিচল। দেবতারা কামদেবের কাছে আসেন এবং তাকে পার্বতীর জন্য শিবের মনে আকাঙ্ক্ষা নির্মিত করতে বলেন। কামদেব শিবকে কামনার তীর নিক্ষেপ করেন।শিব নিজের তৃতীয় চোখ খুলে কামকে পুড়িয়ে ছাই করে দেন।
পার্বতী শিবের আশা বা তার সংকল্প হারান না। তিনি শিবের মতো পাহাড়ে বাস করে তপস্যায় নিযুক্ত হন। পার্বতীর এই রুপ কেই দেবী ব্রহ্মচারিণী বলে মনে করা হয়। তার তপস্বী সাধনা শিবের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং তার আগ্রহ জাগ্রত করে। তিনি ছদ্মবেশে তার সাথে দেখা করেন এবং শিবের দুর্বলতা এবং ব্যক্তিত্বের সমস্যাগুলি গণনা করে তাকে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করেন।পার্বতী শুনতে অস্বীকার করেন এবং তার সংকল্পে জোর দেন।
এই সময় প্রকণ্ডসুর নামক অসুর তার লক্ষাধিক অসুর নিয়ে পার্বতীকে আক্রমণ করে। পার্বতী তার তাপস শেষ করার শেষ পর্যায়ে, এবং নিজেকে রক্ষা করতে অক্ষম। পার্বতীকে অসহায় দেখে, দেবী লক্ষ্মী এবং সরস্বতী হস্তক্ষেপ করেন কিন্তু রাক্ষসদের দ্বারা সংখ্যায় বেশি। অনেক দিন যুদ্ধের পর পার্বতীর পাশের কমণ্ডলু পড়ে যায় এবং বন্যায় সমস্ত রাক্ষস ভেসে যায়। অবশেষে, পার্বতী তার চোখ খুলে দেয়, আগুন নির্গত করে এবং রাক্ষসকে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়।
শিব ছাড়া দেবী পার্বতীর দ্বারা সম্পাদিত তাপস মহাবিশ্বের সকলেই মুগ্ধ। শিব শেষ পর্যন্ত ভ্রমচারীর ছদ্মবেশে দেবী কে দেখতে যান। পার্বতীকে তার ধাঁধা দিয়ে পরীক্ষা করেন, যার উত্তর দেবী সঠিকভাবে দেন। পার্বতীকে তার তীক্ষ্ণ মস্তিষ্ক এবং সৌন্দর্যের জন্য প্রশংসা করার পর, ব্রহ্মচারী হওয়ার প্রস্তাব দেন। পার্বতী উপলব্ধি করেন যে এই ছদ্মবেশ ধারিই শিব এবং তাঁর প্রস্তাব গ্রহণ করেন। শিব তার আসল রূপে আবির্ভূত হন এবং অবশেষে তাকে গ্রহণ করেন। দেবী নিজের তপস্যা ভেঙে দেন। তপস্যা চলাকালীন দেবী প্রবতী বেলপাতা ও নদীর জল দিয়ে পোষণ করেন।
চৈত্র নবরাত্রির শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে দেবী পার্বতীকে ব্রহ্মচারিণী রূপে পূজা করা হয় । দেবী ব্রহ্মচারিণী সাধককে ব্রহ্মজ্ঞান দান করেন। তাঁর পূজা করলে সংযম ও মানসিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি, সাধক অনন্ত পুণ্যফলও লাভ করে থাকেন। সাধক সর্বদা সিদ্ধি এবং বিজয় লাভ করে থাকেন দেবী ব্রহ্মচারিণীর আরাধনা করলে। নবরাত্রির দ্বিতীয় দিনে সাধক নিজের মনকে স্বাধিষ্ঠান চক্রে স্থির করে দেবী ব্রহ্মচারিণীর পূজা করেন। দেবীর জ্যোতির্ময়ী রূপের কথা আরাধনার সময় সাধক মনে কল্পনা করে থাকেন।
ব্রহ্মচারিণী দেবীর মন্দির দুর্গাঘাটে জনবহুল মহারাষ্ট্রীয় ও নেপালি অধ্যুষিত পাড়ায় অবস্থিত। পুরোনো তিন তলা বাড়ির নিচের তলায় বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত। এই মন্দিরের ওপরে মানুষের বাস। মনে হয় মন্দির আগে ছিল, তার ওপর বাড়ি পরে হয়েছে। স্থানীয় লোকেরা একে ছোটো দুর্গাও বলেন। দেবীর মুখে সোনার মুখোশ রয়েছে। তাঁর প্রণামমন্ত্র— দিধানা করপদ্মাভ্যাম্ অক্ষমালা কমণ্ডলু।/ দেবী প্রসীদতু ময়ি ব্রহ্মচারিণ্যনুত্তমা।।’অর্থাৎ ‘জপমালা ও কমণ্ডলুধারিণী দেবী, অনুপমা ব্রহ্মচারিণী জননী, তুমি আমার প্রতি প্রসন্না হও।'
ক্রমশ
Comments
Post a Comment