কাশীর বাসন্তী পুজো
কাশীতে বর্তমানে তীর্থ যাত্রী থেকে পর্যটকের আনাগোনা বেশি। মুঠোফোনে সেলফির হিড়িক চতুর্দিক। কিন্তু মজার ব্যাপার মানুষ বদল হলেও দৃশ্যপট এক। তাহলে কি কাশীতে কেবল ওই গোটা কয়েক স্থান অথবা মন্দির আছে! না না, তা মোটেই নয়। আজ বলবো চন্দ্রঘণ্টা দেবী মন্দির এবং রানী ভবানীর দ্বারা পুনর্নির্মিত মা দুর্গা মন্দিরের কথা।
“পিণ্ডজ প্রবরারূঢ়া চণ্ডকোপাস্ত্ৰকৈতা।/প্রসাদং তনুতে মহং চন্দ্রঘণ্টেতি বিশ্রুতা। অর্থ— “দেবী ব্যাঘ্রবাহনা, রক্তবস্ত্র-পরিহিতা, সুবর্ণবর্ণা, নানা অলংকার শোভিতা, দশভুজা, দশপ্রহরণধারিণীতার অন্যতম একটি ঘণ্টা। প্রচণ্ড বিক্রম এই ঘণ্টাধ্বনির। এর শব্দেই অসুরসৈন্যেরা নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল।”
চন্দ্রঘণ্টা দেবীর মন্দির চৌক থানার ঠিক বিপরীতে চন্দু নাউ (নাপিত)-এর গলি, সি.কে ২৩/৩৪ নম্বর বাড়ি। প্রাচীন এই দেবীর প্রতিমা পাথরের প্রায় ফুটখানেকের মতো। ডক্টর তপন কুমার ঘোষ মহাশয় বলেন, দেবীর সম্বন্ধে কথিত যে ইনি বৌদ্ধদেবী চিত্রঘণ্টা এবং এই প্রতিমা সারনাথ থেকে এখানে এনে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই সম্বন্ধে সারনাথ প্রাপ্ত স্থিরপাল এবং বসন্ত পালের ১০২৬ খৃঃ শিলালেখ উল্লেখযোগ্য। বাংলার সম্রাট গৌড়াধিপ মহীপালের আদেশে স্থিরপাল ও তার অনুজ বসন্তপাল বারাণসীতে ঈশানেশ্বর ও চিত্রঘণ্টা এবং আরো শতাধিক মন্দিরের নির্মাণ করেন। লোকের ধারণা স্থিরপাল ও বসন্ত পালের স্থাপিত চিত্রঘন্টাই আজ হিন্দু দেবী রূপে পূজিতা।
শ্রীশ্রী চণ্ডী বা দেবী সপ্তশতীর উত্তর চরিত্রের সূচনায় দেবী চন্দ্রঘণ্টা মহাসরস্বতীর নবদুর্গা অবতারের তৃতীয় রূপ বলে বর্ণিত। দেবী চন্দ্রঘণ্টার পূজা নবরাত্রি ব্রতের তৃতীয় দিনে শুক্লতৃতীয়াকল্পে সম্পন্ন হয়। মণিপুর চক্রে অবস্থিতা দেবী, কোটিসূর্যসঙ্কাশা দশভুজা ত্রিনেত্রা এই দেবী সাধকের সকল দুর্গতি ও বিঘ্ন নাশ করেন। প্রচলিত লোককাহিনী অনুসারে শিব-পার্বতীর বিবাহের দিনে অনুষ্ঠান পণ্ড করার মানসে তারকাসুর দৈত্যবাহিনী প্রেরণ করলে। বিবাহকার্য নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে দেবী পার্বতী ত্রিনেত্রা দশভুজা সিংহবাহিনী রূপে আবির্ভূতা হন ও চন্দ্রসম বিশাল ও শুভ্র ঘণ্টা বাজিয়ে সকল দৈত্য বিতাড়ন করেন। আরেক মতে শিব বিবাহকালে বিকট রূপ পরিগ্রহ করে ভূতপ্রেতাদি অনুচর সহ বিবাহসভায় উপস্থিত হলে তাঁদের দেখে মেনকা মূর্ছিতা হন। দেবী পার্বতী শিবের এই রূপের বিপ্রতীপে চন্দ্রঘণ্টা রূপ ধারণ করেন। দেবীর এই যোদ্ধৃরূপ দেখে শিব চণ্ড রূপ সংবরণ করেন ও বিবাহের জন্যে অপূর্ব মনোহর চন্দ্রচূড় বা চন্দ্রশেখর রূপ পরিগ্রহ করেন।
নবদুর্গার চতুর্থ রূপ কুষ্মাণ্ড। নবরাত্রি উৎসবের চতুর্থ দিনে তার পূজা করা হয়। দেবীর এইরকম অদ্ভুত নাম কেন? ‘কু’ শব্দের অর্থ কুৎসিত এবং ‘উষ্মা’ শব্দের অর্থ ‘তাপ’; ‘কুষ্মা’ শব্দের অর্থ তাই ত্রিতাপ বা দুঃখ–দেবী জগতের দুঃখ গ্রাস করে নিজের উদরে ধারণ করেন, তাই তার নাম ‘কুষ্মাণ্ডা’। স্বামী অচ্যুতানন্দের ভাষায়, “যেমন মহাদেব সমুদ্রমন্থনের সময় সমস্ত হলাহল পান করে নীলকণ্ঠ হয়েছেন, তেমনি জগজ্জননী দুর্গা আদ্যাশক্তি জগতের সর্বপ্রকার জ্বালা-যন্ত্রণার হাত থেকে সন্তানদের সর্বদা রক্ষা করতে করুণায় দ্রবীভূত হয়ে স্বেচ্ছায় সব তাপ নিজের শরীরে গ্রহণ করেন। দূরিতবারিণী–‘ত্রিতাপহারিণী’ মায়ের নাম তাই কুষ্মাণ্ডা।” দেবী কুষ্মাণ্ডা ত্রিনেত্রা অষ্টভুজা –তাঁর ডান দিকের চার হাতে থাকে যথাক্রমে পদ্ম, বাণ, ধনুক ও কমণ্ডলু; এবং বাঁদিকের চার হাতে থাকে যথাক্রমে চক্র, গদা, অমৃতপূর্ণ রুধিরাপ্লুত ঘট ও জপমালা। তাঁর বাহন সিংহ (কাশীতে বাঘ)। দেবীর ধ্যানমন্ত্র- বন্দে বাঞ্ছিতকামার্থাং চন্দ্রার্ধকৃতশেখরাম্। সিংহস্থাং অষ্টভুজাঞ্চ কুষ্মাণ্ডাং যশস্বিনীম্।।
কুষ্মাণ্ডা দেবীর স্বরূপ বিষয়ে স্বামী অচ্যুতানন্দের লেখা ‘বারাণসী তীর্থ পথে-পথে ঘাটে-ঘাটে' (দেব সাহিত্য কুটীর প্রাইভেট লিমিটেড, ২০০৭, পৃ. ১৫৭) বই থেকে অংশবিশেষ উদ্ধৃত করছি— “ ‘উষ্মা’ শব্দের মানে তাপ। ‘কু’ মানে কুৎসিত, ‘কুষ্মা’ মানে কুৎসিত, কষ্টদায়ক তাপ হচ্ছে ‘ত্রিতাপ’। আধিভৌতিক, আধিদৈবিক ও আধ্যাত্মিক এই ত্রিতাপই জীবের দুঃখের কারণ ।... এই ত্রিতাপ ‘কুষ্মা’ যিনি উদরে ধারণ করেন, গ্রাস করেন, তিনিই কুষ্মাণ্ডা।” শরৎ ও বসন্তের শুক্লা চতুর্থীবছরের এই দুদিন দেবী দুর্গা কুষ্মাণ্ডা রূপে পূজিতা হন।
ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে, দেবী কুশমন্ডাই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছিলেন। তিনিই সৃষ্টির আদি রূপ, আদি শক্তি বলে মনে করা হয়। সৌরজগতের অভ্যন্তরীণ জগতে তাঁর বাস। দেবীর দেহের তেজ সূর্যের মতো এবং সমস্ত দিশা তার দীপ্তি এবং আলো দ্বারা আলোকিত হয়। দুর্গার চতুর্থ রূপী দেবীর আটটি হাত। তাই তাঁকে অষ্টভূজাও বলা হয়। তাঁর সাত হাতে কমণ্ডল, ধনুক, তীর, পদ্ম-ফুল, অমৃত-ভরা কলস, চক্র এবং গদা থাকে। অষ্টম হাতে আছে ঝাপমালা। দেবীর বাহন হিসেবে সিংহের পিঠের উপর অবস্থান করে।
সাধক তাঁর মনকে অনাহত চক্রে রেখে দেবী কুষ্মাণ্ডার পূজা করেন। দেবীর পূজায় রোগশোক দূরীভূত হয়; ভক্ত আয়ু, যশ, বল ও আরোগ্য লাভ করেন। মনে করা হয়, দেবী কুষ্মাণ্ডা অল্প পূজাতেই সন্তুষ্ট হন। তাঁর পূজায় কুষ্মাণ্ড (কুমড়ো) বলি দেওয়ার রীতি আছে। কাশীতে দেবী কুষ্মাণ্ডার মন্দির বিখ্যাত। কাশীতে তিনি দুর্গা নামেই সমধিক পরিচিতা। তিনি কাশীর দক্ষিণ দিকের রক্ষয়িত্রী। কাশীখণ্ড-এ রয়েছে, অসি নদীর সঙ্গমস্থলে কুষ্মাণ্ডার অধিষ্ঠান। দেবীর মন্দিরটি বেশ বড়ো ও বহুচূড়াবিশিষ্ট। লাল পাথরের তৈরি সুদৃশ্য এই মন্দিরের কাছেই কাশীর বিখ্যাত তীর্থ দুর্গাকুণ্ড। এই মন্দিরে হিন্দুধর্মে অবিশ্বাসীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। মূল মন্দিরের গর্ভগৃহে দেবী কুষ্মাণ্ডার পশ্চিমমুখী দুই হাত উঁচু বিগ্রহটি অবস্থিত। কাশীতে শারদীয়া ও বাসন্তী নবরাত্রির চতুর্থীর দিন এই মন্দিরে প্রচুর ভক্তসমাগম হয়।
দেবী-ভাগবত পুরাণ অনুসারে, কাশী নরেশ (বারাণসীর রাজা) তাঁর মেয়ে শশীকালার বিয়ের জন্য স্বয়ম্বর ডাকেন। রাজা পরে জানতে পেরেছিলেন যে রাজকন্যা এক রাজকুমার সুদর্শনের প্রেমে পড়েছিল । কাজেই কাশী নরেশ তার কন্যাকে রাজপুত্রের সাথে গোপনে বিয়ে দেন। অন্যান্য রাজারা (স্বয়ম্বরের জন্য আমন্ত্রিত) বিয়ের বিষয়টি জানতে পেরে, রেগে গিয়ে কাশী নরেশের সাথে যুদ্ধে নামেন। সুদর্শন প্রার্থনা করলে, দেবী সিংহের উপরে এসে কাশী নরেশ এবং সুদর্শনের জন্য যুদ্ধ করেন। যুদ্ধের পরে কাশী নরেশ বারাণসীর সুরক্ষার জন্য দুর্গার কাছে আবেদন করলেন এবং মন্দিরটি নির্মিত হয়।এই মন্দির প্রাঙ্গনের কাছেই এক কুন্ড। কথিত যে মহিষাসুরের সঙ্গে যুদ্ধের পর মা দুর্গা এখনেই কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন এবং কাছ তেকে বয়ে যাওয়া নদির জলে নিজের রক্ত শানিত অসি মানে তরবারি কে ধুয়ে ছিলেন। তাই থেকে সেই নদি অসি নদি রূপে পরিচিত।
১৭৫৩ সালে কাশী অর্থাৎ বেনারসে থাকা কালীন ভবানীশ্বর শিব, দুর্গাকুণ্ড, কুরুক্ষেত্র তলাও নামক জলাশয় স্থাপন, পঞ্চ কোষী পথে স্থিত আনেক দেবালয় ও দুর্গাবাড়ী নির্মাণ করেন। হাওড়া থেকে কাশী পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ করেছিলেন যা রানী ভবানী রোড বা বেনারস রোড নামে খ্যাত। বর্তমানে দুর্গাবাড়ী মন্দিরের যা রূপ আমরা দেখি তা রানী ভবানীর দ্বারা সম্পাদিত। মন্দিরটি উত্তর ভারতীয় নাগারা স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত। লাল রঙ করা মন্দিরের অভ্যন্তরে প্রচুর বিস্তৃত খোদাই করা এবং খোদাই করা পাথর পাওয়া যায়। মন্দিরটি অনেকগুলি ছোট ছোট শিখার সমন্বয়ে গঠিত। বগুড়া জেলার তৎকালীন আদমদিঘী থানাধীন ছাতিয়ান নামক গ্রামে রানী ভবানী জন্মগ্রহণ করেন। খুব অল্প বয়সেই তৎকালীন নাটোরের জমিদার রাজা রামকান্তের সাথে রানী ভবানীর বিয়ে হয়। তার তিন সন্তানদের মধ্যে (২ ছেলে, ১ মেয়ে ) শুধু তারাসুন্দরী জীবিত ছিলেন, কাশীতেই বৈধব্য জীবন কাটান এবং রানী ভবানীর নাম কির্তি কে এক ধাপ আর উন্নত করেন।
Comments
Post a Comment