আচার্য ভরত প্রস্তাবিত অভিনয়রীতি
আচার্য ভরত মূনি কৃত "নাট্যশাস্ত্র" প্রত্যেক শিল্পীর জন্য এক বিশেষ প্রয়োনীয় গ্রন্থ। যাকে আমরা শিল্পানুরাগিদের গীতা বা বাইবেল বলতে পারি। নাট্যশাস্ত্র শিল্পের এমন এক আকর গ্রন্থ ; যার মধ্যে প্রতিটি শিল্পের সমস্ত দুর্লভ তত্ত্ব বিদ্যমান। নাট্য কে তিলোত্তমা শিল্প-ও বলা হয়ে, যার কেন্দ্রে অভিনয়। যাকে বহন করে অভিনেতা, বিভিন্ন অভিনয়রীতি বা পদ্ধতির মাধ্যমে।
অভিনয়রীতি বা পদ্ধতি বা মেথড নিয়ে ভারতের বাইরে যে ভাবে মাথা ঘামানো বা আগ্রহ দেখান হয়েছে; সে ভাবে আধুনিক ভারতে দেখা যায়ে না। প্রফেসর গৌতম চট্টোপাধ্যায় বলেন "নাট্যশাস্ত্র কে একটু গভীর ভাবে পড়লেই আচার্য ভরত প্রস্তাবিত অভিনয়রীতি গুলি ধরা পড়ে; যাকে আধুনিক ভাষায় একটিং মেথড বলতে পারি। যার রচনা আজ থেকে প্রায় আড়াই বছর আগে হয়েছিল। যাকে কখনই আমরা সঠিক ভাবে পড়িনি বা ধরতেই পারিনি।"
মূল গ্রন্থের যে তিনটি প্রমানিত সংস্করণ আমরা পাই তাতে স্পষ্ট ভাবে একটিং মেথড-এর নির্দেশনা নেই। মানে নাট্যশাস্ত্রের ছতত্রিস অধ্যায়ের মধ্যে কোনটাতেই বলা হয়েনি যে অভিনেতাদের জন্য এই রইলো অভিনয়রীতি। এই রীতির অনুসরণ করে অভিনেতা হওয়া যায় বা অনুশীলন করা যায়।
আচার্য ভরত প্রস্তাবিত অভিনয়রীতি উদ্বাবনের জন্য আমরা এখানে হার্ম্যুনিটিক পদ্ধতির অনুসরণ করব। কোনো প্রাচীন গ্রন্থ কে বা তার সংকেত বা সন্ধ্যা-ভাষা কে তার অর্থে পড়ার প্রবিধি, পদ্ধতি ও অনুশীলন কেই হার্ম্যুনিটিক বলা হয়ে। ইশাপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর গ্রীস-এ ঈশ্বরের উপদেশ বা নির্দেশ কে গ্রহণ করে যে বিদ্যান জনমানসের মাঝে তা প্রচারিত করতেন, তাকেই হার্ম্যুনিটিকস বলা হতো। আঠেরই শতাব্দিতে ইউরোপের এই শব্দটি বিব্লিকল টেক্সট কে তার মুলার্থে পড়ার প্রবিধি রূপে যোগ করা হয়ে। বর্তমানে প্রত্যেকটি প্রাচীন দর্শন সাহিত্যের হার্ম্যুনিটিকস এক অনিবার্য সম্পদ।
এখানে সেই ভাষা-শাস্ত্রীয় হার্ম্যুনিটিক প্রবিধি অনুসরণ করে নাট্যশাস্ত্রে বর্ণিত অভিনয়রীতি কে আধুনিক শব্দাবলীতে তুলে ধরছি। যেমন এই সুত্রে -
জগ্রাহ পাঠ্য়্মৃগ্বেদাত সামভয়ো গীতমেব চ।
জাযুর্বেদাদ্ভিন্য়ান রসানাথ বর্ণাদপি।
(নাট্যশাস্ত্র অধ্যায় ১, শ্লোক ১৭)
আচার্য ভরত নিজের অভিনয়্রিতির আরম্ভ বাগ্মিতা (speech) দিয়ে করেন। তাঁর সব সুত্র স্বতন্ত্র ও পূর্ণ , আবার অন্য সূত্রের সঙ্গেও যুক্ত। বৈদিক সূত্রের গুণ-ই এই। এই সুত্রে মুনি ভরত বলছেন - ঋকবেদ থেকে পাঠ,সামবেদ থেকে গান, যজুর্বেদ থেকে অভিনয় এবং অথর্ববেদ দিয়ে রস গ্রহণ করেছেন। এখানেই দু-দন্ড থেমে বোঝার প্রয়োজন। উনি কী ভাবে এই চারী বেদ দিয়ে চারটি তত্ব গ্রহণ করলেন তা স্পষ্ট হয়না।
১৮৯৪ নাট্যশাস্ত্র পূর্ণ প্রকাশিত হয় মুম্বাই থেকে। তারপর বেনারস এবং বডোদা দিয়ে প্রকাশনা। প্রকাশনা থেকে আজ পর্যন্ত কোনো বিদ্বান বা বিশেসজ্ঞ স্পষ্ট করেননা যে বেদ থেকে অভিনয়ের চার অঙ্গ কী ভাবে প্রকাশ পেলো। কেননা ঋক সংহিতায় নাট্যধর্মী পাঠ্য, সাম সংহিতায় সঙ্গীত এবং যযু সংহিতায় অভিনয় সম্বন্ধী কিছুই পাওয়া যায় না। অথর্ব সংহিতার প্রায় সব কারিকায় রসের উল্লেখ তো আছে, কিন্তু সে বিভিন্ন দেবতা প্রদত্ত সোমরস। নাট্যরস বা কোনো ভাবপূর্ণ রস নেই।
এবার যদি আচার্য ভরত প্রণীত উপরোক্ত কারিকাটি লক্ষ করে দেখা হয় এবং আচার্য অভিনবগুপ্তের ব্যাখ্যা কে খুটিয়ে দেখলেই রহস্য উদ্ধার হয়। হার্ম্যুনিটিকস-এর সাহায্যে রহস্য উন্মোচনে পাওয়া যায়, যে পঞ্চম বেদ বা নাট্যশাস্ত্র বা নাট্য-উপনিষদ-এ চারটি বেদের সার মর্ম থাকার মূখ্য অর্থ এই হলো যে পাঠ্যের উচ্চারেই চারটি বেদ কে স্পর্শ করে নেওয়া হয়। যেমন, আমরা যখন উদগিতি বা প্রণব বা ওম শব্দ কে উচ্চার দী তখনই চারি বেদের ভূমিকা স্থাপিত হয় যায়। তাদের সবারই মুখ্যার্থে উপস্থাপনা আমরা করে ফেলি এবং এমনি ভাবেই চারি বেদের মুখ্যার্থ আমাদের উচ্চার-এর সঙ্গে মিলিত হয়ে অভিনয়ের জন্য প্রেরণা যোগায়।
যখন ওম উচ্চার করা হয় তখন আসলে পাঠ্যকেই উচ্চার করা হয়, যার অর্থ তাতেই নিহিত। মানে পাঠ্য (text) "বলা" হয়। এই ভাবে ঋক (ঋকবেদ) উচ্চার পায়, যার অভিপ্রায় হলো পাঠ্য-অংস কে বলা। সেই উচ্চারে পাঠ্য "ওম" এক ধ্বনিযুক্ত গানের মত। তাকে গাওয়া হয়। কোনো সুর কে তার সম্যক রূপে উচ্চার দেওয়াই তাকে গাওয়া। যখন আমরা বারটি সুর কে উচ্চার দী, তার শুদ্ধ, তীব্র ও কমল পর্দা দিয়ে, সেটাই তো গানের পর্যায়ে পড়ে। এই ভাবে দেখলে যখন আমরা 'ওম' বা ওমকার ধ্বনির জপ করি তা আসলে গানই করা হয়। এটাই সাম। সামবেদ। আমরা সামগান বলি। এই ওম্কারের যে অর্থ আমরা বুঝি বা ধরি, সেটাই উচ্চারের সময় ভাব ঘটায়। সেই ভাব নিয়েই আমরা তার উচ্চার করে থাকি। তাতেই যযুর্বেদ বাণী পায় আর ওম্কারের যা ভাব তা অভিনীত হয়। সেই উচ্চারে যা পরিবেশ বা প্রভাব সৃষ্টি আমাদের অন্তরে বা বাইরে ঘটে। সেটাই রস। অথর্ববেদ। এই দৃষ্টিতে যখনই কোনো শব্দ, বাক্য, সংবাদ বলে থাকি; সেই মুহুর্তেই চার বেদের স্পর্শ করি।
ভরত প্রণীত প্রস্তাবিত অযস্র অভিনয়রীতি-পদ্ধতি নাট্যশাস্ত্রের ছ হাজার কারিকায়ে অপেক্ষার্থী। আজ আমরা নাট্যশাস্ত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। অভিনয় পদ্ধতির জন্য অন্যের দারস্থ হচ্ছি। সেখানেই একান্তই আমাদের নাট্যশাস্ত্র অভিনেতাদের জন্য অভিনয়রীতি-পদ্ধতির সমাহার নিয়ে উপেক্ষিত। অভিনেতা যার মন ভারত বা ইউরোপ বা গ্রীক-এ বিভাজিত নয়,সেই বিশ্বমনের অভিনেতার জন্য এই অভিনয়রীতি-পদ্ধতি। এই পদ্ধতি অনুশরণ করে অভিনয়্ধর্মী-মনের কিশোর অভিনেতা; ভারতীয় ধ্রপদী ও প্রাসঙ্গিক অভিনয় শিল্পকে জানবে, শিখবে আর নিপুন হয় উঠবে।
Comments
Post a Comment