কাশী বিশ্বনাথের আরেক রূপ নর্তক আত্মা


কাশী বিশ্বনাথের আরেক রূপ নর্তক আত্মা

কাশীর অধিষ্ঠাতা মহাদেব হলেন তাণ্ডব স্রষ্টা। তাণ্ডব শব্দটি কে সংবাদ পত্রে এমন ভাবে প্রচার করা হয়েছে, যে সে জন্য ভয়ঙ্কর কিছু। সমাজেও এই শব্দের মানে অন্য হয় দাঁড়িয়েছে। 
ভারতীয় শিল্পের আকর গ্রন্থ ভারত মুনি প্রণীত "নাট্যশাস্ত্র"। এই গ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সমুদ্রমন্থন নাটক নির্মাণের পর আচার্য সেই নাটক মহাদেব কে দেখানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেন ব্রহ্মার কাছে। সেই নাটক দেখে শিব প্রীত হয়ে ব্রহ্মা কে বলেছিলেন - অহো নাট্যমিদং সমাক্ ত্বয়া সৃষ্টং মহামতে। যশস্যং চ শুভার্থং চ পুণ্যং বুদ্ধিবিবর্দ্ধনম্।।
তার পর সন্ধ্যাকালে নৃত্য করতে করতে বিভিন্ন করণ' সম্বলিত অঙ্গহার' সমূহ দ্বারা শোভন এই নৃত্যের কথা আমি স্মরণ করলাম। এই পূর্বরঙ্গবিধিতে আপনি (একে) সমাক্ প্রয়োগ করুন। বর্ধমানক আসারিত, গীত' ও মহাগীতে বিষয়গুলি যথাযথরূপে অভিনয় করবেন। যে শুদ্ধ পূর্বরঙ্গের অনুষ্ঠান আপনি করেছেন তা এই (নৃত্য)-গুলির সঙ্গে যুক্ত হয়ে চিত্র নামে অভিহিত হবে।
শিবের কথা শুনে ব্রহ্মা উত্তর দিলেন, হে দেববর, অঙ্গহার'সমূহের প্রয়োগ সম্বন্ধে বলুন। তারপর দেবশ্রেষ্ঠ (শিব) তন্ডুকে ডেকে বললেন-অঙ্গহারগুলির প্রয়োগ সম্বন্ধে ভরতকে বল। 
দেবাদিদেব মহাদেব নিজের তাণ্ডব নৃত্যের সব দীক্ষা নিজের গণ এই তন্ডু কে দিয়েছিলেন। সেই নৃত্য তাণ্ডব।
এই তো গেল প্রাচীন ভারতের কথা। মুধ্য যুগে ভারতে বিভিন্ন অঞ্চলে নানান নৃত্য আমরা দেখতে পাই। তারই মধ্যে কথক অন্যতম। সেই নৃত্যের নিজ ঘরানা। ছয় ঘরানার মধ্যে বনারাস ঘরানা বিশেষ স্থান অর্জন করে। বেনারস ঘরানা জানকীপ্রসাদ ঘরানা নামেও পরিচিত পশ্চিম রাজস্থানের বিকানেরের একজন কত্থক উদ্যোক্তা জানকীপ্রসাদের নামানুসারে, এই নাচের স্কুলটি কিছু বৃত্তে বেনারস ঘরানা নামেও পরিচিত। দেখা যাচ্ছে যে জানকীপ্রসাদ বেনারসে গিয়েছিলেন এবং সেখানে তাঁর বাকি জীবন কত্থক শিখিয়েছিলেন এবং তাঁর নৃত্যের স্কুল বেনারস ঘরানা নামটি অর্জন করে।
কাশীর নৃত্য ও বঙ্গ নৃত্য পরিবেশন এর কথা বলতে হলে। একটি সংস্থার কথা বলতেই হয়। সেই সংস্থার প্রবীণ সদস্য শ্রীমতী রীতি সান্যালের কথায় আমরা তাদের পথ চলার কথা জানতে পারি।
শ্রীমতী সান্যাল জানালেন, কাশী কে বলা হয় কলাকুশলীদের পীঠস্থান। এই কাশীতে ২০০৭ শালে কয়েকজন বান্ধবী এবং এক ভাইয়ের উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল একটি বাঙ্গালী মহিলাগণ সংস্থা *'প্রতিধ্বনি কল্চরল সোসাইটি বারাণসী'* । ২০০৯ সংস্থাটি পঞ্জীকৃত হয়। সংস্থার প্রমুখ কাজ হল শাস্ত্রীয় এবং উপশাস্ত্রীয় নৃত্যের মাধ্যমে (কথক, ওডিসি, মনিপুরী, রাবীন্দ্রিক, কন্টেপররি ) বাংলা সাহিত্যে ও সংস্কৃতিকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা । এই নৃত্য শিক্ষা - নিঃশুল্ক এবং বয়স - সীমাহীন। শিল্প যেমন সীমাহীন তেমনি শিল্পী ও কোনো সীমায় বেঁধে থাকেনা তাই বর্তমানে ৮ থেকে ৮০ সব আয়ুর সদস্যারাই মঞ্চের শোভা বাড়ান। সংস্থাটি মহিলাগত হলেও বহু শুভাকাঙ্ক্ষী ভাইয়েরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংস্থার সঙ্গে যুক্ত এবং সংস্থার শিল্পকর্মেও সহযোগিতা করে থাকেন। তবে সদস্যতা কেবল মহিলারাই পান।
নিজের সীমিত শক্তির ভান্ডার নিয়ে মাত্রীসুলভ মনে 'প্রতিধ্বনি কালচারাল সোসাইটি বারানসি' সমাজের অশক্ত মানুষগুলোর জন্য কিছু করার চেষ্টা নিরলসভাবে করে চলেছে।
১) নাগরি নাটক মন্ডলী -২০২২
২) রমায়ান কনক্লেভ - ২০২১
৩) মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর বারাণসী আগমনের উপলক্ষে 
দেব দীপাবলি (কার্তিক পুর্ণিমা ) - ২০২০
৪) সিমলা কালিবাড়ি -২০১৯
৫) কুম্ভত্মামা এলাহাবাদ-২০১৮
৬) রাষ্ট্রীয় সুর গঙ্গা মহোৎসব -২০১৭
৭) আশ্বিন নাট্য মহোৎসব ২০১৪ এবং ২০১৫
৮) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫০ তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে অনুষ্ঠান-২০১৩
৯) গঙ্গা মহোৎসব- ২০১২
১০) চতুর্থ আন্তর্জাতিক লোকনৃত্য মহোৎসব ইতালি তে অনুষ্ঠিত ২০১১*
১১)ভেন কাশী মহোৎসব - ৩০১০
১২) বৌদ্ধ মহোৎসব -২০০৯
সংস্থা 'দশাবতার' এবং 'শ্রীশ্রীচণ্ডী' ( দুর্গা সপ্তসতি অনুপ্রেরণায়) অনুষ্ঠানটি করে বিশেষভাবে সফলতা অর্জন করেছে।
তাশের দেশ, রবীন্দ্র সঙ্গীত অবলম্বনে রামায়ণ, রবীন্দ্র সঙ্গীত অবলম্বনে বুদ্ধ, আলিবাবা, ভানুসিংহের পদাবলী, নজরুল গীতি অবলম্বনে কবি প্রণাম, চন্ডালিকা, বাল্মিকী প্রতিভা, মেঘদূত, তুষারমালা, গঙ্গা অবতরণ, গীত গোবিন্দ এবং আরও অনেক নৃত্য নাটিকা মঞ্চস্থ করেছে।
এই সংস্থা অযোধ্যা, এলাহাবাদ, লখনউ, পুনে গোয়ালিয়ার, ঝাঁসি এবং জয়পুরে অনুষ্ঠান করেছে।
কাশীতে নিত্য অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। সেই অনুষ্ঠানে অনেক শিল্পী নিজের নিবেদন নিয়ে উপস্থিত হন। তারই মধ্যে একজন কথক নৃত্যশিল্পী কৌশিক মাইতি । কোলকাতা সংলগ্ন ত্রিবেনী নামের একটি ছোট্ট শহরে বসবাস। পরিবারে সঙ্গীত জগত থেকে কেউ নেই। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই নৃত্য সংগীতের প্রতি ছিল একটা চরম আগ্রহ। সেই দেখে বাবা একটি নৃত্যনাট্যের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করে দেন। সেখানে বেশ কিছুদিন শেখার পরে মোটামুটি ভালই সুনাম অর্জন। সেখানে কিছুদিন শেখার পর একটি ভরতনাট্যমের শিক্ষাক্ষেত্রে ভর্তি হন। 
ভরত নাট্যম থেকে কথকে এলেন কি ভাবে? তিনি জানান- ভালো লাগছিল শিখতে, কিন্তু সেই যেন ভালোবাসাটা তৈরি হচ্ছিল না, যেটা আমি চাই। তখনো আমার কথক নৃত্যের সাথে পরিচিতি ঘটেনি। সেই গুরুকুলের শিক্ষিকা আমাকে বলেন তুমি কথক নৃত্যের শিক্ষাক্ষেত্রে যোগদান কর। যেমন বলা তেমন কাজ সঙ্গে সঙ্গে একটি কথক নৃত্যের প্রতিষ্ঠানে আমি ভর্তি হয়ে গেলাম। এইবার মনে হচ্ছিল যেটা আমি চেয়েছিলাম সেটাই যেন পেলাম। সেই স্বপ্নে শুনতে পাওয়া ঘুঙুরের ছনকার, তবলার আওয়াজ পাখোয়াজ এর ধ্বনি সারেঙ্গীর সুর সব যেন আমার মিথ্যে মিলেমিশে এক হয়ে গেল। ধীরে ধীরে শিখতে শিখতে এক ভালোবাসা, পরে শিল্পটির প্রতি শ্রদ্ধা এবং ধীরে ধীরে সাধনা তৈরি হলো। ক্রমে আমি বঙ্গীয় সঙ্গীত পরিষদ থেকে নৃত্য বিভাকর এবং দা ইন্ডিয়ান মিউজিক এন্ড ফাইন আর্টস একাডেমি থেকে নৃত্য বিশারদ উপাধি গুলি অর্জন করলাম। পথ চলা ধীরে ধীরে শুরু হলো। অনেক উত্থান পতনের মাধ্যমে নৃত্যকে সঙ্গে নিয়ে চলে এসেছি অনেকটা দূর আর পিছনে ফিরে তাকাবার কোন সুযোগ নেই, ইচ্ছাও নেই। বেশ কিছু বছর আমি ওই শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষা নেওয়ার পরে সন্ধান পাই কোলকাতা সংলগ্ন উত্তরপাড়া মাখলা নামক স্থানে এক গুরু কথক নৃত্যের শিক্ষা দেন যিনি গুরু পদ্মবিভূষণ বিরজু মহারাজের জীর শিষ্যা তার নাম বিদুষী Dr কেয়া চন্দ জী। আগের গুরু জীর কাছে অনুমতি নিয়ে কেয়া দিদি র কাছে প্রশিক্ষণ নিতে চলে গেলাম।প্রথম দিনেই উনি আমার নৃত্যের প্রশংসা করেছিলেন এটা আজও আমার মনে আছে। পরম্পরাগত কথক নৃত্য কিভাবে মঞ্চস্থ করতে হয় সেটা তার হাত ধরেই আমার শেখা। বকে ঝোকে যেভাবেই হোক উনি ঠিক আমাদের তৈরি করে নিতেন। তখন হয়তো বুঝতাম না ,আজ বুঝি সেই বকাঝকার পিছনে কতটা আদর, ভালোবাসা এবং স্নেহ লুকিয়ে ছিল। ওনার কাছে শিক্ষা নেবার পর অনেক কর্মশালাতে আমি গুরু পদ্মবিভূষণ বিরজু মহারাজ জি এবং ওনার সুযোগ্য শিষ্যা বিদূষী শাশ্বতী সেন জির সান্নিধ্য পেয়েছি। ২০১৯ সালে জুন মাসে একটি কর্মশালাতে মহারাজ জি নিজে মুখে আমার নৃত্যের প্রশংসা করেন। এর থেকে বড় প্রাপ্তি হয়তো আমার সারা জীবনে আর কিছু আসবেনা। আকাশের মতো একজন বড় মানুষ যিনি সাক্ষাৎ ঈশ্বরের রূপ তিনি আমার নৃত্যের প্রশংসা করেছেন এর থেকে বড় শংসাপত্র আমার জীবনে আর কিছু হয় না। ইতিমধ্যে আমার জীবনে নিজেকে মঞ্চস্থ করার পালা এসে গেছিল। বিভিন্ন জায়গায় নিজেকে মঞ্চস্থ করছিলাম এবং যেখানে যেখানে গেছি সেখানে সেখানেই গুরুজনের আশীর্বাদ এবং দর্শকদের ভালবাসা পেয়েছি।
কথক নৃত্যের কথা বা আমার কথা বলতে গেলে বারবার বারাণসী শহরের কথা উঠে আসে। প্রথম কথা তো কথক নৃত্যের মূল কেন্দ্র গুলির মধ্যে বারানসি একটি অন্যতম পিঠস্থান এবং বাবা বিশ্বনাথ স্বয়ং নটরাজ। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে প্রথম কোথাও নৃত্য নিবেদন যদি আমি করে থাকি তাহলে সেটা বারাণসী। হয়তো এটা ভগবান নটরাজেরই ইচ্ছা ছিল। যখন আমি বারাণসী প্রথম পদার্পণ করি তখন যেন বারাণসীকে আমার খুব চেনা লাগছিল। যেন জন্ম জন্মান্তরের সম্বন্ধ। এখানকার গলি এখানকার ঘাট এখানকার মানুষজন যেন কত নিজের। আমি একজন কথক নৃত্যশিল্পী, আমার তো বারাণসী ভালো লাগবেই এটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। আমি ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে অনুষ্ঠান করেছি নিজেকে মঞ্চস্থ করেছি কিন্তু বারাণসী এসে নিজের নৃত্যের অঞ্জলি দিয়ে যে ভালোবাসা যে সম্মান আমি পাই সেই ভালোবাসা বা সেই সম্মান বা সেই শান্তি আর যেন কোথাও গিয়ে মেলেনা। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে ঋষিকেশ ভারত মাতা মিশন এর বারানসি শাখা থেকে ভারতীয় সংস্কৃতির তথা কথক নৃত্যের ধারক এবং বাহক হিসাবে অধ্যক্ষ পদের সম্মানে আমাকে সম্মানিত করা হয় । নৃত্যে নিবেদন যখনই আমি কাশিতে করতে আসি তখনই নৃত্যের সাথে আধ্যাত্মিক অনুভূতি আমি উপলব্ধি করি, যেটি আর অন্য কোথাও গেলে হয় না। বারানসি শহরে একজন কথক নৃত্যশিল্পী হিসাবে আমার যতটা সম্মান ততটা হয়তো আমার নিজের শহরেও আমার নেই। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা আমি যেমন ভারতীয় সংস্কৃতির ধারক বাহক হিসাবে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে নৃত্যের নিবেদন করতে থাকছি ঠিক তেমনি বারংবার বারানসি শহরেও যেন ঠিক এই ভাবেই বাবা বিশ্বনাথের শ্রী চরণে নিজের নিত্যাঞ্জলী দিতে পারি।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে আমি ত্রিবেণী তে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি, এবং বিভিন্ন জায়গায় আমি কর্মশালার মাধ্যমে কথক নৃত্যের শিক্ষা প্রদান করি। কাশী তেও আমি বেশকিছু শিশু শিল্পীকে কথক নৃত্যের প্রশিক্ষণ দিয়েছি। আমার জীবন নৃত্যে নিবেদিত। নৃত্য কে এগিয়ে দিয়ে যেতে আমি গুরু র কাছে বচনবদ্ধ, তাই আগামী প্রজন্মকে কথক নৃত্যের প্রশিক্ষন দিয়ে ও নিজে কথক নৃত্য কে মঞ্চস্থ করে সকলকে আমাদের ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করাই।
আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবসটি ইউনেস্কোর পারফর্মিং আর্টসের প্রধান অংশীদার ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট আইটিআই-এর নৃত্য কমিটি দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল। ১৯৮২ সালে এর সৃষ্টির পর থেকে, আন্তর্জাতিক নৃত্য কমিটি এবং আন্তর্জাতিক থিয়েটার ইনস্টিটিউট আইটিআই প্রতি বছর আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবসের জন্য একটি বার্তা লেখার জন্য একটি অসামান্য নৃত্য ব্যক্তিত্ব নির্বাচন করে। এই দিনটি তাদের জন্য একটি উদযাপনের দিন যারা "নৃত্য" শিল্পের মূল্য এবং গুরুত্ব দেখতে পায় এবং সরকার, রাজনীতিবিদ এবং প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি জাগরণ-আহ্বান হিসাবে কাজ করে যারা এখনও জনগণের কাছে এর মূল্য স্বীকার করেনি। ব্যক্তি এবং এখনও অর্থনৈতিক বৃদ্ধির জন্য তার সম্ভাবনা উপলব্ধি করা হয়নি।

Comments

Popular posts from this blog

আচার্য ভরত প্রস্তাবিত অভিনয়রীতি

কাশীর বাঙালী টোলার দ্বীতিয় পাতালেশ্বর