মহামিলনের মহামূর্খ মেলা, কাশী


১৯৬৯ সালে মুক্তি পায়ে ভারতের হিন্দি ভাষার একটি ফিল্ম, মৃণাল সেন পরিচালিত এই চলচিত্রের নাম ভুবন সোম।  বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় রচিত একটি বাংলা গল্পের উপর ভিত্তি করে মৃণাল সেন তাঁর এই চলচ্চিত্রটি তৈরি করেছিলেন। ভুবন সোম আধুনিক ভারতীয় চলচ্চিত্রের একটি যুগান্তকারী সৃষ্টি হিসাবে বিবেচিত।  ভুবন সোমকে ভারতীয় নিউ ওয়েভ সিনেমার পথিকৃৎ বলেও মানা হয়। জাতীয় চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার অর্থ সহায়তায় নির্মিত প্রথম দিকের চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে অন্যতম। এক কথায় অনন্য। মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুহাসিনী মুলে ( গৌরী, একটি গ্রাম্য প্রফুল্ল তরুণীর চরিত্রে ) এবং ভুবন সোম চরিত্রে ভারতীয় চলচিত্রের কাল্ট অভিনেতা উৎপল দত্ত ।
ভুবন সোম চরিত্রটি অদ্ভুত।সে বিপত্নিক ও নিবেদিতপ্রাণ সিভিল সার্ভেন্ট ভুবন সোম একজন কঠোর, আপোষহীন - ভারতীয় রেলওয়ের "বড় কর্মকর্তা"।  যে শুধু বোঝে কাজ। সে গম্ভীর, মেজাজি, মুখে হাঁসি নেই। তার ছেলে তার থে দূরে সরে গিয়ে চলে গেছে কাশী … । এমন চরিত্র আমরা অহরোহ দেখে থাকি। এ হেন চরিত্রের প্রয়োজন এমন একটা খোলা বাতাস যেখানে সে একটু স্বাভাবিক হবে। এই মানসিক এবং বিকট চাপে থাকা মানুষের জন্য কৃত্রিম হাঁসির ক্লাব গড়ে উঠছে।
১৯৬৯ এপ্রিল মাসে কাশীর গঙ্গা বক্ষে বজরার ওপর এক মেলা বসে, ভুবন সোমের মত মানুষ কে একটু প্রাণ খুলে হাঁসির সুযোগ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে অথবা বলা যায় তাঁদের মত অনেক কে প্রকৃতিস্থ হতে এক পরিবেশ সৃষ্টি। কাশী তে নিত্য মেলা চলে এতে নতুন কি। লাক্ষা মেলাই প্রায় গোটা দশ এক। যেমন রথজাত্রা, রামলীলা, নাক্কাটাইয়া, ভারত মিলাপ ইতাদি ইত্যাদি। করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে।  কিন্তু এই মেলা একটু ভিন্ন। যার নামই মহা মূর্খ মেলা। কি শুনেই মনে এক কৌতূহল জাগে না?
এই মেলার বিষয় অধ্যাপক শ্রী সমীর নাথ চক্রবর্তী মহাশয় বলেন, এ এক অদ্ভুত মেলা ! এই মেলায় বিচিত্র সব ঘটনার প্রত্যক্ষ দর্শী হন দর্শক মণ্ডলী। এই মেলার জন্য বছর ভর প্রতীক্ষা করে থেকেন না জানি কতজন। আগে আমি যখন বাঙালি টলার গঙ্গা মহল অঞ্চলে নিজের পৈত্রিক বাড়ি তে থাকতাম তখন দশাশ্বমেধের কাছে থাকার দরুন প্রায় এই মেলার সাক্ষী হতাম। এখন আমরা সুসুহাই অঞ্চলে নিজের বাড়ি করে ছলে গেছি। এখন ত আর কাশী ক্ষেত্র সেই উনিশ শতকের মত গুটিয়ে নেই। তাই বাঙালি সম্প্রদায় অনেক ছড়িয়ে গেছে শহর ময়।
সমীর মহাশয় এই মহামুরখ মেলার রিতি নিতি বিষয় বলেন, পয়েলা এপ্রিল দিনটি এই মেলার নির্ধারিত তিথি। সকলে শুধু বাঁধ ভাঙ্গা হাঁসির হুল্লোড়ে আকাশ ভরিয়ে দিতে চায়। মেলা আরম্ভ হয়ে গাধার ডাক দিয়ে, জেন যুদ্ধের রণভেরি। গর্দভের আওয়াজ সনা মত্রই মানুষের ভিড় জমতে থাকে, এক সময় তিল ধারনের স্থান থাকে না। মহামুর্খ মেলায়, ডাঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ ঘাটের নিচ থেকে উপরে সিঁড়িতে বসে থাকা হাজার হাজার দর্শক শুধু হাসির খরাকের তাগিদে সেখানে যায়। পুরবাঞ্চলের লোক নৃত্য ধোবিয়া নাচ ছাড়া, অনুষ্ঠানের এক আদ্ভুত বিয়ে লকেদের কৌতূহলের বিষয়, অমিল বিয়ের সাক্ষী হয় কাশী। প্রতিবার এক দম্পতির এখানে বিয়ে গড়ে এবং কিছুক্ষণেই সেই বন্ধন ভেঙ্গে যায়। এই বিয়ে তে বর সাজে বউ আর বউ সাজে বর। আজগুবি মন্ত্রে দম্পতীর সাতপাক পূর্ণ হয়। সেই বিয়ের পর আরম্ভ হয়, কাব্যের আসর। হাস্য ও ব্যেঙ্গময় কাব্য সুনে রাত কাটে। এই আসর ভরে শেশ হয়ে অমিল বিয়ের দম্পতীর বিবাহ বিছেদে। 
মহামুর্খ সম্মেলনের আহ্বায়ক, হাস্যরসাত্মক ব্যঙ্গের স্রষ্টা বিখ্যাত কবি পন্ডিত সুদামা তিওয়ারি (সান্ড বেনারসি) বলেন যে মহামুর্খ মেলা প্রথম শুরু হয়েছিল ১৯৬৯ সালে দশাশ্বমেধঘাটের একটি বজরায়। প্রথমবারের মতো উত্তরপ্রদেশের রাজ্যপাল হোমি মোদির ছেলে সাংসদ পিলু মোদি বর এবং কাশীর ধনী মহেন্দ্র শাহ কনে সেজে ছিলেন। বিগত সাড়ে পাঁচ দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে চলছে মহামূর্খ মেলা। এ বছর মহামুর্খ মেলার ৫৬তম বছর। মহামুর্খা সম্মেলনের প্রথম আহ্বায়ক ছিলেন পন্ডিত ধর্মশীল চতুর্বেদী। তার সাথে এই মহা মূর্খ  সুদামা তিওয়ারি সাঁদ বেনারসী ছিলেন। এখন তাঁর মৃত্যুর পরও সাঁড বেনারসি ও দামদার বেনারসি এই মেলার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালনে রয়েছে। 
তিনি আরও বলেন যে ১৯৭১ সালে, মহামুর্খ সম্মেলন দশাশ্বমেধ ঘাট থেকে চক থানার সামনে অবস্থিত ভদ্দোগলের প্রাসাদে আনা হয়েছিল। এ সময় মাইক ছাড়া অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয়, যার কারণে অনেকে অনুষ্ঠান শুনতে পেতেন না। দশ বছর ধরে ভদ্দোমালের বাড়িতে এই অনুষ্ঠান চলতে থাকে। পরের দুই বছর ধরে চক থানা চত্বরেও অনুষ্ঠান পালিত করা হয়। এরপর ৮৩ থেকে ৮৫ সাল পর্যন্ত নাগরী নাটক মন্ডলির প্রাঙ্গনে, কবিরচৌড়ায় এটি হতে থাকে। ১৯৮৬ সালের পর, এটি ডাঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ ঘাটে স্থানান্তরিত হয়। এরপর থেকে এখানে ধারাবাহিকভাবে অনুষ্ঠান হয়ে আসছে। তিনি জানান, এই অনুষ্ঠানে কাশীর প্রবীণ সাহিত্যিক ও সাংবাদিকদের মধ্যে প্রয়াত ড. সেখানে ছিলেন মাধব প্রসাদ মিশ্র, মোহন লাল গুপ্ত ভাইয়াজি বেনারসি, লক্ষ্মী শঙ্কর ব্যাস, বেধব বেনারসি, দীননাথ গুপ্ত, বিখ্যাত কার্টুনিস্ট কাজিলাল, চকাচক বেনারসি সহ অনেকে। এখন পর্যন্ত অনেক মন্ত্রী, সাংসদ ও বিধায়ক মহামুর্খা সম্মেলনে পাত্র-পাত্রী হয়েছেন। বিশেষ বিষয় হলো মহামুর্খা সম্মেলনকে প্রচার করতে শহরে কোনো পোস্টার বা কোনো ব্যানার লাগানো হয় না। তা সত্ত্বেও ডাঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ ঘাটে এত ভিড় জড় হয় যে ঘাটে বসার জায়গাও থাকে না। সবই মহাদেবের ইচ্ছা।

Comments

Popular posts from this blog

আচার্য ভরত প্রস্তাবিত অভিনয়রীতি

কাশীর বাঙালী টোলার দ্বীতিয় পাতালেশ্বর