বর্তমান কি আদৌ ভারত মাতা মন্দির মনে আছে


বারানসীর কড়চা 
জয়দেব দাস, কাশী 
কাশী, শব্দ টি কানে এলেই মনে এক ধরনের ভাব জাগে। ভক্তিভাবই সব ভাবের উর্ধে। কানে ভেসে আসে গঙ্গার কুল কুল শব্দ, ঘাটের উপর বিশাল প্রাসাদের খোপে বাসা বাধা পাখিদের কলরব, নানা ঘণ্টি, খুঞ্জুনির কিরতন। চখের সামনে সেই শহরের চিত্র-উতসব, আরতি, দেবালয়, মন্দির …। কল্পনাতেও আসে নে যে কাশীতে এমনও কোন মন্দির থাকতে পারে যেখানে কোন দেব বা দেবী নেই, নিত্য পূজা আর্চাও নেই, নেই কোন পুরহিত, নেই কোন শঙ্খ ধ্বনি অথবা ধুনি! 
বারাণসী জঙ্কশন স্টেশনে নেমে যে রাস্তাটি গোদৌলিয়ার দিকে যায়, সেই পথে কিছু দুরেই মহাত্মা গান্ধী কাশী বিদ্যাপীঠ নামক এক বিশ্ববিদ্যালয় তারই প্রাঙ্গনে এই মন্দির। মন্দিরের কোন চুড়ো নেই, দেখলে মনে হয় দু’তলা বাড়ি। মন্দিরে ভাবনায় ও স্থাপনে ডক্টর শিব প্রসাদ গুপ্ত। 
শিব প্রসাদ গুপ্ত একজন দূরদর্শী, জনহিতৈষী, ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন নেতা এবং মহাত্মা গান্ধী কাশী বিদ্যাপীঠের প্রতিষ্ঠাতা।  অত্যন্ত ধনী শিল্পপতি এবং "জমিদার" পরিবারের হলেও, তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা এবং আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য তার সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেন। তিনি মহাত্মা গান্ধী, পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু, বাল গঙ্গাধর তিলক, মহামনা মদন মোহন মালব্য এবং অন্যান্য সমস্ত জাতীয়তাবাদী নেতাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং বন্ধু ছিলেন। 
স্বাধীনতার আগে নির্মিত মন্দিরটি দেশপ্রেমের এক অনন্য উদাহরণ। মন্দিরটি, শিল্পপতি এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী বাবু শিব প্রসাদ গুপ্ত প্রধান স্থপতি দুর্গা প্রসাদ খত্রীর নির্দেশে নির্মাণ করেন। মন্দিরটি ভারত মাতা মন্দির নামে প্রসিদ্ধ। 
ভারত মাতা এই শব্দের উল্লেখ হলেই আনন্দমঠ’ উপন্যাসের কথা মনে পড়বেই।১৮৮১, খ্রীষ্টাব্দের প্রারম্ভেই বঙ্কিমচন্দ্র হুগলী হইতে হাওড়ায় বদলি হন; হাওড়াতে আসিয়াই স্থানীয় কলেক্টর সি. ই. বালণ্ডের সহিত তাঁহার বিবাদ বাধে, এবং ইহার অব্যবহিত পরেই তাঁহার পিতা যাদবচন্দ্রের মৃত্যু হয়। 'আনন্দমঠ' এই সময়ের রচনা।'আনন্দমঠ' রচনার সময় বঙ্কিমচন্দ্র কিছু কাল কলিকাতায় বাসা ভাড়া করে থাকতেন। চন্দ্রনাথ বসু মহাশয় লিখছেন, বউবাজার স্ট্রীটের যে বাড়ীর সম্মুখের খণ্ডে এক্ষণে মুখুজী কোম্পানির হোমিওপেথিক ঔষধের দোকান দেখিতে পাওয়া যায় দিন কতক তিনি সেই বাড়ীতে ছিলেন।...এক দিন বৈকালে সেই বাড়ীতে গেলাম। বঙ্কিমবাবু আনন্দমঠের পাণ্ডুলিপি পড়িয়া শুনাইতে আরম্ভ করিলেন। 
বঙ্কিম বাবুর বন্দেমাতরম গান সেই ভারত মা কেই উদ্দেশ্য করে লেখা। “বন্দে মাতরম্” গান রচনা সম্পর্কে ইতিমধ্যেই বহু কিম্বদন্তী প্রচলিত। অনেকের ধারণা ‘আনন্দমঠ' লেখার পূর্ব্বে রচিত; কেউ মনে করেন বঙ্কিমচন্দ্র বহরমপুরে ডফিন্ সাহেব কর্তৃক অপমানিত হয়ে প্রতিহিংসাপরবশচিত্তে রচনা করিয়াছিলেন। “বন্দে মাতরম্” গানের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে বঙ্কিমচন্দ্রের নিজের যে উচ্চ ধারণা ছিল, শ্রীশচন্দ্র মজুমদার এবং বঙ্কিম-কন্যা প্রমুখ অনেকে তা বিবৃত করেছেন ।
‘আনন্দমঠ’, ‘আনন্দমঠে'র বিভিন্ন চরিত্র, দেশমাতৃকার পূজা ও “বন্দে মাতরম্” সম্পর্কে এদেশে এবং বিদেশে অসংখ্য আলোচনা হয়েছে। নিম্নলিখিত আলোচনা উল্লেখযোগ্য—The Encyclopædia Britannica, 11th Edition, Vol. VI, pp. 9-10; Dr. G. A. Grierson-The Times, Sept 12, 1906; Sir Henry Cotton The Times, Sept. 13, 1906; J. D. Anderson-The Times, Sept. 24, 1906; গিরিজা প্রসন্ন রায় চৌধুরী—‘বঙ্কিমচন্দ্র। আনন্দমঠ'; S. M. Mitra—Indian Problems, London, 1908; Lord Ronaldshay-The Heart of Aryavarta, Chapter X; Verney Lovett-History of the Indian Nationalist Movement, pp. 62-63; G. T. Garratt-An Indian Commentary, p. 136; J. D. Anderson-The Modern Review, Jan. 1919; - aff'; Sir Surendranath Banerjea-A Nation in Making; Count Keyserling—The Book of Marriage; কালীপ্রসন্ন ঘোষ – “আনন্দমঠের মূলমন্ত্র”, ‘বান্ধব’, ৭ম বর্ষ ; বিষ্ণুচরণ চট্টোপাধ্যায় - 'নব্যভারত', ১ম খণ্ড ; পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় - “বঙ্কিমচন্দ্রের ত্রয়ী”, “নারায়ণ', বৈশাখ, ১৩২২ ; কিরণশঙ্কর রায় – “আনন্দমঠ”, ‘সবুজপত্র’, ১৩২৬; ললিতচন্দ্র মিত্র— 'স্বদেশ প্রতিমা'; Sri Aurobindo Rishi Bunkim Chandra ; অক্ষয়কুমার দত্তগুপ্ত—'বঙ্কিমচন্দ্ৰ' পৃ. ৩০৮-৩৩৮ ; নবীনচন্দ্র সেন 'আমার জীবন' ২য়-৩য় খণ্ড ; Jayanta Kumar Das Gupta Life and Novels of Bankim Candra, pp. 102-111; শচীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়— 'বঙ্কিম-জীবনী', ৩য় সংস্করণ, পৃ. ২৮৬-৩০৩; পূর্ণচন্দ্র বসু—'কাব্যসুন্দরী', পৃ. ২০০-২২৩; যতীন্দ্রমোহন গুপ্ত—“বাঙ্গালার মাতৃমূৰ্ত্তি”, ‘বঙ্গদর্শন', অগ্রহায়ণ, ১৩১৭; ইত্যাদি। 
২৫ অক্টোবর, ১৯৩৬-এ মহাত্মা গান্ধী দ্বারা ভারত মাতা মন্দির উদ্বোধন করা হয়ে, স্বাধীন ভারত গঠনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক স্বাধীনতা সংগ্রামীর প্রতি শ্রদ্ধা জানানর প্রতিক রূপে। এই মন্দিরের সবচেয়ে মজার বিষয় হল এই মন্দিরে কোন দেব-দেবীর মূর্তি বা বিগ্রহ নেই। রয়েছে এটি ভারতীয় মানচিত্র, অবিভক্ত ভারতের। পুনের বিদ্যা আশ্রমের মেঝেতে তৈরি একটি মানচিত্র এবং ব্রিটিশ মিউজিয়ামের বিস্তারিত মানচিত্র থেকে অনুপ্রাণিত। এই মানচিত্রটি প্রতিটি স্বাধীনতা সংগ্রামীর স্বপ্নকে চিত্রিত করে যারা ভারতের স্বাধীনতা পাওয়ার আগে ব্রিটিশ আমলের সাক্ষী হয়েছিলেন। নির্মাণের নিষ্ঠা অসাধারণ। এই অসাধারণ জায়গাটি ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের কষ্টের সাক্ষী হয়েছে। এটি মহামা গান্ধীর 'নো ভায়োলেন্স' ধারণার উত্তরাধিকার। ভারত মাতা মন্দির স্বাধীন ভারতের প্রশান্তি ও মহিমা যাত্রার প্রতীক। মন্দিরের বিশাল হল ঘরের মেঝের কেন্দ্রে, পাকিস্তান, আফগানিস্তান সহ বেলুচিস্তান, বাংলাদেশ এবং মায়ানমার নিয়ে গঠিত; রয়েছে যা বার্মা এবং শ্রীলঙ্কা জুক্ত ভারতের অবিভক্ত মানচিত্র। 
এই মানচিত্রে প্রায় 450টি পর্বতশৃঙ্গ, জলাশয়, বিস্তীর্ণ সমভূমি এবং মার্বেল দিয়ে খোদাই করা মালভূমি এবং এতে চিহ্নিত ভৌগলিক স্থাপনার গভীরতা এবং স্কেল রয়েছে। ল্যান্ডমার্কের শিখর মাউন্ট এভারেস্ট এবং K2 চূড়া এবং চীনের গ্রেট ওয়ালকে চিত্রিত করে। অসংখ্য চূড়ার উচ্চতার মধ্যে পার্থক্য স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। এক ইঞ্চি সমতল পৃষ্ঠের প্রায় 6.40 মাইল জুড়ে আপনি বেসমেন্টের মাটিতে ইনস্টল করা জানালা থেকে পৃথিবীতে বিদ্যমান একই অনুপাত এবং উচ্চতার পার্থক্য দেখতে পাবেন। সমুদ্রের উপমহাদেশের আশেপাশে ছোট ছোট শৃঙ্গগুলিও একটি পয়েন্টেড স্টিক বা লেজার টর্চের সাহায্যে দেখা যায়। মানচিত্রে চিত্রিত জলাশয়গুলি জলে ভরা থাকে এবং প্রতিটি প্রজাতন্ত্র ও স্বাধীনতা দিবসে ভূমির পৃষ্ঠগুলি ফুলে সজ্জিত হয়। 20 শতকের জাতীয় হিন্দি কবি মৈথিলি শরণ গুপ্ত, ভারত মাতা মন্দিরের উদ্বোধনের উপর একটি কবিতা রচনা করেছিলেন যা ভবনের ভিতরে একটি পেন্টিং প্রদর্শিত হয়েছে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত চিত্রকর্ম দ্বারা অনুপ্রাণিত ভারত মাতার একটি মূর্তি রয়েছে।  

https://youtu.be/A0XU8tcZ1R8?si=HJ_p6PnMsnHa74hI

ভোট পর্ব শেষ। উত্তর প্রদেশে ভরতিয় জনতা পার্টি আসা অনুরুপ ভোট পায়েনি। বিশেষ করে রাম মন্দির গড়ার পরেও অযোধ্যা থেকে তারা হেরেছে। কাশী বিশ্বনাথ মন্দির করিডর করেও কাশীর জনতা সে হারে ভোট দেয়ে নি যা আগে দিয়েছিল। আজ প্রধানমন্ত্রী কাশী তে এসেছেন। তাই আগে থেকেই যোগী আদিত্যনাথ নগরের দিকে এক নজর দিয়ে গেছেন। মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, কাশীতে থাকার সময়, গত শুক্রবার রাতে দর্শন পূজার পরে ভারত মাতা মন্দির কমপ্লেক্সে নির্মাণাধীন রোপওয়ে প্রকল্পের সাইট পরিদর্শন করেছিলেন। প্রকল্পের অগ্রগতি জানার পর সময়মতো কাজ শেষ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। কাশী রোপওয়ে হবে ভারতের প্রথম পাবলিক ট্রান্সপোর্ট রোপওয়ে। এটি 3.75 কিলোমিটার দীর্ঘ হবে যেখানে পাঁচটি স্টেশন ক্যান্ট রেলওয়ে স্টেশন থেকে গোদাউলিয়া চককে সংযুক্ত করবে। এটি 2025 সালের মে মাসে চালু হবে বলে আশা করা হচ্ছে। রোপওয়ে নির্মাণের জন্য সুইজারল্যান্ড থেকে আনা যন্ত্রপাতি বসানো হচ্ছে। এই কাজটি করছে সুইস কোম্পানি বার্থহোলেট।
এখন ভাবনার বিষয় এই রোপওয়ে প্রকল্পের জন্য ভারত মাতা মন্দিরের শ্রী হানি হবে না ত। ভারত মাতা মন্দির দেখার সেরা সময় হল প্রজাতন্ত্র দিবস এবং স্বাধীনতা দিবস। এই জাতীয় উৎসবে স্বাধীনতার গল্প ও সংগ্রামের কথা বলা হয়। কোন ভিজিটিং ফি নেই আগ্রহীরা যেকোন ঋতুতে সকাল সাড়ে ৯টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত মন্দিরে যেতে পারবেন।

Comments

Popular posts from this blog

আচার্য ভরত প্রস্তাবিত অভিনয়রীতি

কাশীর বাঙালী টোলার দ্বীতিয় পাতালেশ্বর