বারানসীর শ্রীক্ষেত্র নব সংস্কারের পথে

 
কাশী ধামে শ্রী শ্রী মা সারদা গঙ্গা স্নান সেরে অসি ঘাট থেকে গেলেন অসি মাধব দর্শনে। অসি মাধব জগন্নাথের রূপ। বিগ্রহ দর্শনে সানন্দ- বিস্ময়ে মাতা বলিয়া উঠিলেন,-ওমা কাশীতেও জগন্নাথ এসে বসে আছেন! তা বেশ হয়েছে, যিনি জগন্নাথ তিনিই বিশ্বনাথ।

অসি মাধব জগন্নাথের এই প্রাঙ্গণই হল কাশীর শ্রীক্ষেত্র, অসি ঘাটের ঠিক অপরেই এক বিশাল প্রাঙ্গন জুড়ে এই দেবালয়। জগন্নাথ, সুবোধরা ও বলভদ্র প্রতিষ্ঠিত। নিত্য পুজো হয়। আশি ঘাটের কাছে অবস্থিত জগন্নাথ মন্দিরটি ওড়িশার পুরীতে অবস্থিত জগন্নাথ ধামের একটি প্রতিরূপ মনে করা হয়। এই মন্দিরটি ১৮০২ সালে ভোঁসাল রাজ্যের দুই নাগরিক বিশ্বম্ভর রাম এবং বেণী রাম দ্বারা নির্মিত। বিশ্বাস করা হয় যে বারাণসীতে অবস্থিত এই মন্দিরে দর্শনে ভক্তরা ওডিশায় অবস্থিত জগন্নাথ ধামের মতোই পুণ্য ফল পান। দেবতাদের পূজার আচার ও পদ্ধতি পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের মতোই। এই মন্দিরের চার কোণায় চারটি বৈষ্ণব দেব মূর্তি রয়েছে, যথা কৃষ্ণ, রাম পঞ্চায়েত, কৃষ্ণের কালিয়ামর্ধন রূপ এবং লক্ষ্মী-নারায়ণ। রথের দিনে জগন্নাথ, সুবোধরা ও বলভদ্র এই তীন বিগ্রহ কে পালকি করে নিয়ে জাওয়া হয় রথজাত্রা নামক স্থানে। সেখানেই রথের মেলা তিনদিন। কাশীর লাক্ষা মেলা নামেও খ্যাত। 

বিংশ শতাব্দীর আশির দশক পর্যন্ত এই খেত্র জন মানুষ শুন্য ছিল বললেই চলে। একদমই যে কেউ থাকতেন না তাও নয়। যেমন মন্দির প্রাঙ্গনের দক্ষিন প্রান্তে, নদির কাছে ছিল জ্ঞান চক্রবর্তীর এক প্রাসাদ বাড়ি। চারিদিকে গাছ গাছারি ভর্তি। গঙ্গা পর্যন্ত গাঁদা ফুলের গাছের চাদর…। 
সত্যজিত বাবুর কথায়-আমাদের দরকার ছিল শুটিং-এর জন্য। এক হল গল্পের ভণ্ড সাধু মছলিবাবার জন্য ঘাটের ধারে-কাছে একটি গোপন আস্তানা; আর দুই হল, যে ঘোষালদের আড়াই ইঞ্চি লম্বা সোনার গণেশ চুরি নিয়ে রহস্য, তাদের জন্য মানানসই একটা পুরনো বাড়ি। … মছলিবাবার ডেরা তো পাওয়া গেল, আর সেই সঙ্গে প্যালেসে শুটিং করার অনুমতিও আদায় করে নেওয়া হল। এবার বাকি ঘোষালদের বাড়ি। খোঁজ করে আমাদের চাহিদা অনুযায়ী দুটো বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেল। একটা মেমুরগঞ্জের সাহাদের বাড়ি। গিয়ে দেখলাম মোটামুটি গল্পের বর্ণনার সঙ্গে মিলে যায়, কিন্তু তার আশেপাশে বেনারসের কোনও চিহ্ন নেই। এখানে শুটিং করাও যা কলকাতাতেও তাই। এ বাড়ি বাতিল করে আমরা চলে গেলাম নাগওয়া। 
এই নাগওয়ার ঘাট থেকেই সাঁকো পেরিয়ে রামনগর জেত তখন। নাগওয়ার যে অংশে বাড়ি, সেটার নাম লঙ্কা। বাড়ির মালিক ছিলেন উত্তর প্রদেশের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাইসচালের জ্ঞান চক্রবর্তী। তিনি মারা গেছেন অনেককাল। পরবর্তী কালে বাড়ি চলে যায় ডালমিয়াদের হাতে। এখন সেই বাড়ি এক স্কুল। গেট দিয়ে ঢুকে বেশ কিছুটা হাঁটার পর গাছপালার আবরণ সরে গিয়ে বাড়িটা দেখা যায়। বিশাল অট্টালিকা। চারদিকে বিস্তীর্ণ জমি, এককালে বেশ রমরমা ছিল সেটা দেখেই বোঝা যায়। ঘোষালবাড়িই বটে। পাশেই গঙ্গা, তবে বর্ষায় জল বাড়লেও এ বাড়ির একতলা অবধি পৌঁছবে না, কারণ ভিত প্রায় দশ হাত উঁচু, প্রথম তলায় পৌঁছতে অনেকগুলো সিঁড়ি ভাঙতে হয়। জমিটা ছিল নাকি এক মেমসাহেবের। তাঁর সঙ্গে এই জ্ঞান চক্রবর্তীর আলাপ হয়। তার অল্পদিন পরেই মেমসাহেব স্বপ্নে জানেন যে পূর্বজন্মে জ্ঞান চক্রবর্তী ছিলেন তাঁর নিজের ছেলে। অনেকদিন কাশীতে থেকে ভদ্রমহিলার হিন্দু ধর্মের প্রতি টান হয়, পূর্বজন্ম-টন্ম সম্বন্ধেও বিশ্বাস জন্মায় । এই স্বপ্ন দেখার ফলে মেমসাহেব তাঁর জমিজমা সম্পত্তি সব কিছু চক্রবর্তী মশাইকে দান করে যান। চক্রবর্তীমশাই বাড়িটি তৈরি করেন আর উনিশ শো আটাত্তর সালে সেখানে হয় ফেলুদার ছবির শুটিং।

ঘোষালদের জন্য এত ভাল আর এমন জুতসই একটা বাড়ি পাওয়াতে মনটা নেচে উঠেছিল সত্যজিত বাবুর, তার পর যখন জানলেন যে এখানে শুটিং করার অনুমতি পেতে তাঁর কোনও অসুবিধা হবে না, তখন আনন্দের সঙ্গে পরম নিশ্চিত্তির ভাব নিয়ে তিন দিনের কাশীবাস শেষ করে কলকাতায় ফিরেছিলেন।

বর্তমানে সকাল সকাল কাশী হিন্দু বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্ররা এক বিশেষ চায়ের স্বাদের সন্ধানে অসির বাঙালি দাদার খোঁজ করে। নাম পদবি না জানলেও সে অঞ্চলে বাঙালি দাদা নামেই খ্যাত। দোকানের বয়েস প্রায় ২৫ বছর। মুখার্জি পরিবারের ছেলে। ভাল নাম সঞ্জয় মুখার্জি। তিনি বলেন, জগন্নাথ মন্দির প্রাঙ্গনে ছিল একটা কুণ্ড আর অনেক আমলকী গাছ। তাই আনেকে বিশেষ করে এখানকার বাঙালি এই স্থানকে আমলকী তলা বলে পরিচয় দিত। শিত কালে চড়ুই ভাতির জন্য প্রিয় জায়েগা। 
সময়ের সাথে সাথে এখানে বস্তি গড়ে উঠল। আশির দশকেই বালি তলার মজুর, যারা বাংলার পূর্ব সিমানার কাছ থেকেই এসেছিল বলে মনে করা হয়। বালি তলার কাজ বধ হয়ায়, কাজ হারাল। অন্য পথ বেছে নিতে বাধ্য হয় টানা রিক্সা কে আজিবিকা করে নিল কিছু জন। নদির ধারে, মন্দির প্রাঙ্গনের পূর্ব-দক্ষিন সিমানাএ নিজেদের ঘাটি বাঁধল। নগয়া বলেই স্থানটি পরিচিত। 

আস্তে আস্তে চারিদিকে নতুন ঘর বাড়ি হল। হল কলনি। এই মন্দির প্রাঙ্গনের জমিতেও লোকেরা বে আইনি ভাবে দখল নিল। বিশেষ করে অসি ঘাটের পাসেই নতুন অসি ঘাট নির্মিত হল, তখন থেকেই শ্রী রত্নেশ বর্মার নেতৃত্বে সুবহ-এ-বনারাস অনুষ্ঠান টির খ্যাতির জন্য নিত্য লকের সমাগম বেড়েই চলল। সকাল সন্ধ্যে মেলার রূপ নিতে জমে উঠল নানা ধরনের দোকান পাট। হোটেল ব্যাবসা। সবই প্রায় শ্রী ক্ষেরের জমির অপর। 

“জগন্নাথ করিডোরের জন্য 300টি বাড়ি ভেঙে ফেলার আদেশ”-এই খবর পাওয়ায়ে অঞ্চলিক বাসিন্দাদের মাথায় বজ্রাঘাত।অসি কলোনির অসন্তুষ্ট বাসিন্দারা যুক্তি দেন যে মোদি কাশীকে ভুল বুঝেছেন, এবং যদি তিনি এই পথে চলতে থাকেন, তাহলে কাশীর পরিচয় শীঘ্রই ধ্বংস হয়ে যাবে।করিডোরের পরিকল্পনা প্রস্তাবিত হওয়ায়, বাসিন্দারা মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট (এসডিএম) আদালতের কাছ থেকে তথ্য পেয়েছেন যে তারা যে জমিতে বসবাস করছেন তা সরকারের অন্তর্গত এবং তাদের শীঘ্রই এটি ছেড়ে যেতে হবে।এরা সেইসব লোক যাদের পূর্বপুরুষরা তাদের জমি রেজিস্ট্রি করেছিলেন এবং তাদের বাড়ি তৈরি করেছিলেন, এবং এখনও, জগন্নাথ করিডোরে থাকার জন্য প্রায় 300টি বাড়ি ভেঙে ফেলা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

এক স্থানীয় বলেন যে এই বার্তা শুনে, তাদের মধ্যে অনেকে এসডিএম আদালতে যান, যেখানে তাদের একজন অফিসের কর্মচারীর সাথে দেখা হয়, সে তাদের জানিয়েছিলেন যে 'উপর থেকে' আদেশ তাকে সেগুলি গ্রহণ করতে নিষেধ করে। তারপরে তারা উচ্চ আদালতে যান এবং শেষ পর্যন্ত এসডিএম আদালত থেকে একটি আদেশ পান যাতে তারা তাদের কথা শুনতে পারে।
বিশ্বনাথ করিডোরের ক্ষেত্রে, ভেঙে ফেলা বাড়িগুলির মধ্যে অনেকগুলি রাজাদের ছিল এবং শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের দ্বারা দখল করা হয়েছিল। যাইহোক, জগন্নাথ করিডোরের পথের বাড়িগুলি বৈধভাবে এই স্থানীয়দের মালিকানাধীন, এবং তারা দাবি করে যে তাদের জমি আসলে তাদের নয় এমন কোনও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই।

তারা বলেছেন যে তারা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মুখ্যমন্ত্রীর কার্যালয় এবং এমনকি অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কাছে চিঠি লিখেছেন, তবুও তাদের দুর্দশা উপেক্ষা করা হচ্ছে। বিকাশ বা প্রগতির নামে সরকার কতটা ধ্বংসের ন্যায্যতা দিতে পারে? ওই এলাকার বাসিন্দারা মনে করেন, লকডাউন চলাকালীন আরও একটি করিডোর তৈরির জন্য এক হাজারেরও বেশি বাড়ি ভেঙে ফেলা হয়েছিল। ক্ষুব্ধ অসি কলোনির বাসিন্দারা।
লোকেরা প্রায়শই কাশীতে এসেছে 'মৃত্যুর জন্য', 'মোক্ষ প্রাপ্তির' নামে, এবং এই স্থানীয়রা দাবি করে যে তারা মরতে প্রস্তুত এবং তাদের বাড়িঘর ভেঙে তাদের সমাধিস্থল হয়ে উঠুক এবং জগন্নাথ করিডোর তাদের সমাধিতে পরিণত হোক। 'বিকাস কে নাম পে বিনাশ ' (প্রগতির নামে ধ্বংস), একজন বাসিন্দা দাবি করেছেন, তার হতাশা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছিলেন যে কাশী হল আলোকিত এবং স্বাধীনতা, মুক্তি এবং মোক্ষের শহর, কোনও বিনোদন পার্ক নয় যা উচ্চ রাজস্ব সংগ্রহের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।

কাশী বলতে কী বোঝায়, ' ধর্ম '-এর প্রকৃত অর্থ কী তা সম্পূর্ণ ভুল বোঝাবুঝি নির্দেশ করবে। এই লোকেরা নিজেদেরকে ধার্মিক মানুষ বলে মনে করে যারা তাদের গুরু শঙ্করাচার্যকে শ্রদ্ধা করে। যাইহোক, তারা জোর দিয়ে বলেছেন যে মোদীর ধর্ম অনেকটা ধর্মের ছদ্মবেশে বাণিজ্যিকীকরণের মতো মনে হচ্ছে। সর্বোপরি, রাবণও একজন ধার্মিক মানুষ ছিলেন!
তাদের যুক্তি হল মোদি কাশীকে ভুল বুঝেছেন, এবং যদি তিনি এই পথে চলতে থাকেন, তাহলে কাশীর পরিচয় শীঘ্রই ধ্বংস হয়ে যাবে এবং নতুন এবং বিদেশী কিছু দ্বারা প্রতিস্থাপিত হবে। ব্যাপক বাণিজ্যিকীকরণের উপস্থিতি ইতিমধ্যে কাশীর আত্মাকে বিক্রি করে দিয়েছে। সত্য হল এরা হিন্দু, কাশীর বাসিন্দা, যারা পবিত্র নগরী বলতে কী বোঝায় তা বোঝে এবং তারা মনে করে যে 'ধর্মের' নামে কাশীকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করে বিক্রি করা হচ্ছে।

Comments

Popular posts from this blog

আচার্য ভরত প্রস্তাবিত অভিনয়রীতি

কাশীর বাঙালী টোলার দ্বীতিয় পাতালেশ্বর