বিশ্ব রঙ্গমঞ্চ দিবস ২০২৪
২০২৪ উদযাপনের আয়োজন ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট প্রস্তুত। আয়োজকরা এই বিশ্বের বিরল অনুষ্ঠানের জন্য সমস্ত বিবরণ প্রস্তুত করেছেন। তারা জানিয়েছেন এই উৎসব যৌথভাবে আন্তর্জাতিক থিয়েটার ইনস্টিটিউট এবং চাইনিজ থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন দ্বারা সংগঠিত এবং ল্যাংফাং পৌরসভার সহায়তায় ল্যাংফাং সিল্ক রোড ইন্টারন্যাশনাল আর্টস সেন্টার দ্বারা আয়োজিত করা হবে।
প্রতিবারের মত এই বছরও বিশ্বের এক নাট্য ব্যক্তিত্ব এই দিবস উপলক্ষে নিজের বার্তা সবার সামনে রাখবেন।
২০২৪ এর বিশ্ব নাট্য দিবসের উপলক্ষে বার্তার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে নরওয়ের জন ফসে কে। জন ফসে একজন বিখ্যাত নরওয়েজিয়ান লেখক যিনি ১৯৫৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তার বিস্তৃত কাজের জন্য পরিচিত, যার মধ্যে রয়েছে নাটক, উপন্যাস, কবিতার সংগ্রহ, প্রবন্ধ, শিশুদের বই এবং অনুবাদ। ফসের লেখার শৈলী minimalism এবং আবেগগত গভীরতা দ্বারা চিহ্নিত করা হয়, যা তাকে বিশ্বের সবচেয়ে অভিনয় নাট্যকারদের একজন করে তোলে। ২০২৩ সালে, তিনি তার উদ্ভাবনী নাটক এবং গদ্যের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন যা অকথ্যকে কণ্ঠ দেয়।
ফসের কাজ পঞ্চাশটিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে, বিশ্বব্যাপী এক হাজারেরও বেশি পর্যায়ে প্রযোজনা উপস্থাপন করা হয়েছে। তাঁর ন্যূনতম এবং অন্তর্মুখী নাটকগুলি, প্রায়শই গীতিমূলক গদ্য এবং কবিতার সীমানায়, ১৯ শতকে হেনরিক ইবসেন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নাটকীয় ঐতিহ্যকে অব্যাহত রাখে। ফসের কাজ পোস্ট-ড্রামাটিক থিয়েটারের সাথে যুক্ত হয়েছে, এবং তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলিকে তাদের ন্যূনতমতা, গীতিবাদ এবং সিনট্যাক্সের অপ্রচলিত ব্যবহারের কারণে উত্তর-আধুনিকতাবাদী এবং অ্যাভান্ট-গার্ড হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
ফস তার নাটক "নোকন কেজেম তিল অ কোমে" (1996; "কেউ কেউ আসছেন", 2002) নাটকের মাধ্যমে একজন নাট্যকার হিসাবে আন্তর্জাতিক প্রশংসা অর্জন করেছিলেন, যা ভাষার আমূল হ্রাস এবং মানুষের আবেগের শক্তিশালী প্রকাশের জন্য পরিচিত। স্যামুয়েল বেকেট এবং টমাস বার্নহার্ডের মতো শিল্পীদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে, ফস আধুনিকতাবাদী কৌশলগুলির সাথে স্থানীয় বন্ধনগুলিকে একত্রিত করেছেন। তার কাজগুলি নিহিলিস্টিক অবজ্ঞা ছাড়াই মানুষের অভিজ্ঞতার অনিশ্চয়তা এবং দুর্বলতাগুলিকে চিত্রিত করেছে।
তার নাটকগুলিতে, ফস প্রায়ই অসম্পূর্ণ শব্দ বা কাজ ছেড়ে দেয়, অমীমাংসিত উত্তেজনার অনুভূতি তৈরি করে। অনিশ্চয়তা এবং উদ্বেগের থিমগুলি "নাট্টা সিং সাইন গানার" (1998; "নাইটসংস", 2002) এবং "ডসভারিয়াসজোনার" (2002; "মৃত্যুর ভিন্নতা", 2004) এর মতো নাটকগুলিতে অন্বেষণ করা হয়েছে। দৈনন্দিন জীবনের উদ্বেগের মধ্যে ফসসের সাহস তার ব্যাপক স্বীকৃতিতে অবদান রেখেছে।
ফসের উপন্যাস, যেমন "মরগন ওগ কেভেল্ড" (2000; "মর্নিং অ্যান্ড ইভিনিং", 2015) এবং "ডেট এর আলেস" (2004; "অ্যালিস অ্যাট দ্য ফায়ার", 2010), তার অনন্য ভাষা প্রদর্শন করে যা বিরাম, বাধা, অস্বীকার, এবং গভীর প্রশ্ন. ট্রিলজি "Trilogien" (2016) এবং septology "Det Andre namnet" (2019; "The Other Name", 2020) আরও দেখায় ফসের প্রেম, সহিংসতা, মৃত্যু এবং মিলনের অন্বেষণ।
ফোসের চিত্রকল্প এবং প্রতীকবাদের ব্যবহার তার কাব্য রচনায় স্পষ্ট, যার মধ্যে রয়েছে "স্টারক ভিন্ড" (2021) এবং তার কবিতা সংকলন "ডিক্ট আই সামলিং" (2021)। তিনি জর্জ ট্রাকল এবং রেইনার মারিয়া রিল্কের রচনাগুলি নাইনর্স্কে অনুবাদ করেছেন।
সামগ্রিকভাবে, জন ফসের কাজগুলি মানুষের অবস্থার সারমর্মকে আবিষ্কার করে, অনিশ্চয়তা, উদ্বেগ, প্রেম এবং ক্ষতির থিমগুলি মোকাবেলা করে। তার অনন্য লেখার শৈলী এবং দৈনন্দিন পরিস্থিতির গভীর অনুসন্ধানের সাথে, তিনি নিজেকে সমসাময়িক সাহিত্য ও থিয়েটারে একজন প্রধান ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
বিশ্বনাট্য দিবসের বার্তা ২০২৪
প্রত্যেক ব্যক্তিই অন্য কারোর মতো, তবু অনন্য। এটি বেশ ভালো যে আমরা অন্যের থেকে পৃথক। কিন্তু আমাদের প্রত্যেকের অন্তরঙ্গে কিছু আছে যা একান্ত নিজস্ব। আমরা এটাকে সত্তা বা মন বলতে পারি। আবার বিশেষ কোনো শব্দে না বেঁধে উন্মুক্তও রাখতে পারি।
তবে একে অন্যের থেকে পৃথক হয়েও আমরা সাযুজ্য বজায় রাখি। পৃথিবীর সব প্রান্তের মানুষই ভাষা, বর্ণ, চুলের রং নির্বিশেষে মূলগত ভাবে অভিন্ন।
এর মধ্যে হয়তো একটি বিরোধাভাষ আছে যে একইসঙ্গে আমরা সম্পূর্ণ এক এবং ভীষণভাবে আলাদা। দেহ এবং মনের যে বাস্তবিক এবং স্পৃশ্য অস্তিত্ব তার সাথে আমরা সেতুবন্ধন করতে চাই পরমার্থিকের যা বস্তুগত সত্তাকে অতিক্রম করে এবং সেক্ষেত্রে মানুষের ভূমিকা অন্তর্গতভাবে বৈপরীত্যে পূর্ণ বলে প্রতিভাত হতে পারে।
শিল্প, বিশেষত অর্থপূর্ণ শিল্পকর্ম অনিন্দ্য সুন্দরভাবে অনন্যের সাথে বৈশ্বিক-এর মিলন ঘটায়। এটি আমাদের বুঝতে সাহায্য করে বৈশ্বিক হওয়ার সাথে সাথে তফাতের জায়গাটা কোথায় বা বহিরাগত উপাদানগুলি কি। এটি অর্জন করতে গিয়ে শিল্প ভেঙে ফেলে ভাষার সীমান। পার হয়ে যায় ভৌগোলিক অংশ তথা দেশের গণ্ডি। এটি শুধুমাত্র প্রত্যেক ব্যক্তির স্বতন্ত্রতাকে একত্রিত করে না, বৃহদার্থে প্রত্যেক গোষ্ঠীবদ্ধ ও জাতিভুক্ত মানুষের ঐশী সত্তাকে যূথবদ্ধ করে।
এটা করতে গিয়ে শিল্প তফাৎ বা সাদৃশ্যের জায়গাগুলোকে একমাত্রিক করে ফেলে না, বরং দেখিয়ে দেয় আমাদের থেকে কোনটা পৃথক, সংযোগহীন বা দূরবর্তী। যেকোনো ভালো শিল্প-কর্ম এসব আপাত সংযোগহীনতাকে ধারণ করে যাকে আমরা পুরোপুরি অনুধাবন করতে না পারলেও কিছুটা আত্মস্থ করি। যেন এটা কোন রহস্যের ধারক যা আমাদের বিমুগ্ধ করে, তাড়িত করে নিজেদের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে এবং এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সে জন্ম দেয় এক উৎকর্ষতার যা প্রত্যেক শিল্পের আধার এবং যার দিকে শিল্প আমাদের নিয়ে যায়।
এভাবে বিপরীতমুখী উপাদানকে কাছে আনার এর চেয়ে ভালো কোন মাধ্যমের কথা আমার জানা নেই। আধুনিক বিশ্বে আমরা প্রায়শই দেখি হিংসাত্মক বিরোধিতা ধ্বংসাত্মক রূপ নিয়ে যা কিছু পৃথক, বহিরাগত এবং অনুপম তাকে মুছে দিতে উদ্যত। আর এই কাজে সহায়তা করে চূড়ান্ত অমানবিক সব আবিষ্কার, প্রযুক্তির দৌলতে যা আমাদের হাতের মুঠোয়। শিল্প ঠিক এর উল্টো কাজ করে। পৃথিবীতে সন্ত্রাসবাদ আছে, আছে যুদ্ধ কারণ মানুষের মধ্যে একটি জান্তবতা কাজ করে- যা প্রণোদিত হয় পৃথক বা ভিনদেশী যা কিছু তার সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা লাভের স্বাভাবিক প্রবণতা থেকে। পৃথক অস্তিত্বসমূহের কাছে এটি আতঙ্কের। একে কখনোই চিত্তাকর্ষক রহস্যের সাথে তুলনা করা যায় না।
এভাবেই আস্তে আস্তে হারিয়ে যায় বৈচিত্র যাকে আমরা ভিন্নতা বলি, রেখে যায় সামূহিক অভেদ যেখানে সকল পৃথকই একটা আতঙ্ক যাকে নিধন করতে হবে। বাইরে থেকে যাকে দেখলে পৃথক বলে মনে হয়, রাজনৈতিক মতবাদ, ধর্ম এসব যেকোনো ক্ষেত্রেই, সেগুলি সবই হয়ে ওঠে নির্মূল করার বা পরাস্ত করার লক্ষ্যবস্তু।
আমাদের অন্তরে যা কিছু নিমগ্ন রয়েছে অনন্য রূপে তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নাম হল যুদ্ধ। তাই লড়াইটা সরাসরি শিল্পের বিরুদ্ধে এবং সব শিল্পের গভীরে যা নিহিত আছে তার বিরুদ্ধে।
আমি এখানে বিশেষভাবে নাটক বা নাটকের কথা না বলে সামগ্রিকভাবে শিল্প সম্বন্ধে কথা বলছি। কারণ, ইতিমধ্যেই যেটা বলেছি, সকল ভালো শিল্পকর্ম তার অন্তঃস্থলে একটা বিষয়কে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয় আর সেটা হলো যা সম্পূর্ণভাবে মৌলিক, নির্দিষ্ট সেই বিশেষকে শৈল্পিকভাবে প্রকাশ করে বহির্বিশ্বের সাথে সংযুক্ত করা এবং সর্বজনীন করা; তার বিশেষতাকে নিশ্চিহ্ন না করে, তাকে জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করা যাতে যা কিছু ভিন্ন, বহিরাগত, অচেনা তা যেন উজ্জ্বলতায় ভাস্বর হয়।
শিল্প আর যুদ্ধের অবস্থান বিপ্রতীপ, ঠিক যুদ্ধ আর শান্তির মতো। খুব সহজ করে বললে, শিল্পই হল সেই শান্তি।
জন ফসে
Comments
Post a Comment