কাশীর হোলি, বুড়ুআ মঙ্গল ও রাজনিতি গতিপথ
মহান গায়িকা সিদ্ধেশ্বরী দেবী হোলিতে রাগ সাহানায় একটি বন্ধিশ গাইতেন 'খেলুঙ্গি হোলি আজ শ্যাম সে দন্ট কে'... ইয়ে জো দান্ট কে হ্যায় ওহি বেনারসি হোলির মূল অর্থ। বেনারসে, হোলি অপরিচিতদের সাথে নয়, প্রিয়জনের সাথে খেলা হত। হোলির সময় গালাগালি দেওয়া হত শুধু পরিচিত ও আত্মীয়দের। এখন হোলির প্রকৃতি নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে।
প্রবীণ সাংস্কৃতিক সমালোচক পন্ডিত অমিতাভ ভট্টাচার্যের মনে বেনারসি হোলির স্মৃতিগুলি এখনও বেঁচে আছে। তিনি বলেন যে এই শহরটি এত নির্মম এবং নিষ্ঠুর নয়, তবে বেনারস নামটি সামাজিকভাবে সদয় এবং সমতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে পূর্ণ একটি বিস্ময়কর জনসংখ্যা। স্বাধীনতার পর বেনারসি হোলির আসল রূপ বদলের প্রধান কারণ হয়ে ওঠে প্রচুর বহিরাগত মানুষের আগমনে। সব জায়গার মানুষ বেনারসের হোলিতে তাদের অঞ্চলের প্রভাব যুক্ত করেছে। অশ্লিলতার রঙ্গ ভরেছে।
বেনারসি হোলির আসল রূপ এখন পুরোপুরি বদলে গেছে। বিজয়ার পরিবর্তে সোম সংস্কৃতি সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে বেনারসের হোলির। আমি যখন মাত্র পাঁচ দশক পিছনে তাকাই, সবকিছু অন্যরকম দেখায়। দশাশ্বমেধের ডেঢশিপুলে (বর্তমানে গোদলিয়া থেকে দশাস্বমেধ পথের মাঝে স্থিত বিশ্বনাথ মন্দিরে যাওয়ার সিংহ দ্বার সেখানেই ছিল উক্ত সেতু) হোলির সন্ধ্যায় বুদ্ধিজীবীদের সমাবেশ হতো। তাদের সকলেই বাধ্যতামূলকভাবে মসলিন ধুতি এবং অর্ধ দৈর্ঘ্যের কুর্তা পরতেন। প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করে একটি দুপল্লি টুপি মাথায় রাখতেন। যা দিয়ে, অপরিচিতরাও তাদের সম্প্রদায়কে চিনতে পারে। এক এক জনগোষ্ঠীর দুপল্লি টুপির ধরন ও নকশা ছিল একেক রকম।
রামনগরী দুপালিয়া শুধুমাত্র রামনগর থেকে আগত লোকেরা ব্যবহার করত। বসবাসকারী অভিজাতদের দুপালিয়ার টুপির উপর পাড়ের সেলাই ছিল আলাদা। গুজরাটি হীরা ব্যবসায়ীর দুপালিয়ায় রঙ্গিন হাতের কাজ দেখার মত ছিল। অনেক সময় এটি পরে সাহিত্যিক, ব্যঙ্গশিল্পী, চিত্রশিল্পী ও সাংবাদিকরা পানের দোকানে ভিড় জমাতেন।
সুনেছি কাশীর কাব্য অনুষ্ঠান গুলি এই সময় অশ্লিল হয়ে ওঠে। এই কথায় বলেন, আগেই বলেছি বহিরাগত আমদানি। সেই সময় কোন কবি কম সংখ্যক অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করে অসাধারণ সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতে পারে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা হতো। সেই প্রতিযোগিতায় ডালে লবণের মতো গালি দেওয়া হতো। বেনারসে সাহিত্যের ঐতিহ্য আছে। বেনারসের সবকিছুই রূপক।
হোলির পর মঙ্গলবার পর্যন্ত কাশীতে সাহিত্যিকদের হোলি চলতে থাকে, যা ঐতিহ্যগতভাবে বুধোয়া মঙ্গল নামে পরিচিত। অভিনয়ম সংস্থা তিন দশক ধরে প্রাচীন বুদ্ধমঙ্গলের বিলুপ্তপ্রায় শাখায় সাহিত্য আন্দোলনকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। শতাধিক উদীয়মান ও প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক সন্ধ্যা থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত কবিতা আবৃত্তি করতেন গঙ্গার অপর ভাসমান বজড়ায়ে; খির, মালাই, রাবড়ি ও বেনারসি মিষ্টির ভোজের মধ্যে।
সুরেন্দ্র জি বলেন যে অভিনয়ম উৎসবের কেন্দ্রবিন্দুতে ঘনশ্যাম গুপ্ত, পন্ডিত অশোক মিশ্র 'সমকাল' এবং পন্ডিত গয়া প্রসাদ শাস্ত্রী মত লোক থাকলেও পণ্ডিত অমিতাভ ভট্টাচার্য লেখা ললিত অভিনন্দন পত্র বুড়ূআ মঙ্গলের কাব্যিক নৃত্যের প্রাণ হয়ে উঠত।
নবগীতি ধারার কবি সুরেন্দ্র বাজপেয়ী স্মরণ করেন যে বুড়ুআ মঙ্গলের কবিতার আসর সন্ধ্যা সাতটা থেকে পর দিন সকাল সাতটা পর্যন্ত গঙ্গার ঢেউয়ের উপর ভাসমান বজড়া চলত। আমি যদি পঞ্চাশ -এর দশকের হোলির কথা বলি, প্রথম যে কথা মনে আসে তা হল দশাশ্বমেধ অঞ্চলের সাহিত্যিকদের সমাবেশ। জয়শঙ্কর প্রসাদের ছেলে রত্নাশঙ্কর প্রসাদ, বেঢব বেনারসি, বেধড়ক বেনারসি, পুষ্কর জি, শক্তিনারায়ণ সিং, মোহনলাল গুপ্ত 'ভৈয়াজি বেনারসি', ত্রিলোচন শাস্ত্রী, পন্ডিত হরিরাম দ্বিবেদীর মতো মানুষ। আমার মনে আছে, একই জায়গায় বিখ্যাত ঠুমরি গায়ক পন্ডিত মহাদেব মিশ্র 'হোরি' গানটি এমনভাবে গেয়েছিলেন যে মানুষ নাচতে শুরু করেছিল।
কাশীর বসন্ত উতসবের শেষে রাজনৈতিক পরিবেশ তেঁতে উঠেছে। কাশীর সাংসদ হয়ে আবার নরেন্দ্র মোদী মাঠে নামলে, তাকে টেক্কা দেবে কে তা নিয়ে পানের ঠেক থেকে চায়ের আড্ডায়ে চলছে জল্পনা। সেই জল্পনার কিছু সুরাহা হয়েছে কংগ্রেসের পদক্ষেপে।
বারাণসী লোকসভা আসন থেকে ইন্ডিয়া অ্যালায়েন্সের প্রার্থী এবং কংগ্রেসের রাজ্য সভাপতি অজয় রায় রবিবার প্রার্থী ঘোষণা করার পরে তার প্রথম আগমনে জেলার বিভিন্ন স্থানে স্বাগত জানানো হয়ে। তিনি দাবি করেন, কাশীর মানুষ পরিবর্তনের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ভারত জোট পূর্ণ শক্তি নিয়ে নির্বাচনে লড়বে।
অজয় রায়, লখনউ থেকে সড়কপথে কাশী পৌঁছে, প্রথমে পিন্দ্রা বাজারে অবস্থিত লক্ষ্মী মাতা মন্দিরে দর্শন সেরে, গিলাট বাজার মোড়ে রাজর্ষি উদয়প্রতাপ সিং, কাছারিতে ডঃ আম্বেদকর, মালদহিয়াতে সর্দার প্যাটেল এবং লাহুরাবীরে চন্দ্রশেখর আজাদ এর মূর্তি তে মাল্যদান করেন। লাহুরাবীরে নিজের বাসভবনে অজয় রায় বলেন, আজ পর্যন্ত কাশীতে মৌলিক জনসমস্যার সমাধান হয়নি। বিশুদ্ধ পানীয় জল ও পয়ঃনিষ্কাশনের সমস্যায় মানুষ অতিষ্ঠ। বিজেপি গণতন্ত্র হত্যা করছে বলে তাঁর অভিযোগ। কংগ্রেস মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, অবিচার, কৃষকদের সমস্যা, এমএসপি, মহিলাদের নিরাপত্তা, নির্বাচনী বন্ডে বিজেপির পুনরুদ্ধার ইত্যাদির মতো প্রধান ইস্যুতে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে।
বোঝা যাচ্ছে রাজনৈতিক আখারায় সবার নজর কাশীর দিকেই থাকছে। কাশীর ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে জে স্বাদিনতার আগে এবং পরবর্তী কালেও কাশী মহৎ ভুমিকা পালন করে এসেছে। কিছুদিন আগেই শহিদ দিবস পালন করেছে দেশ। ভগত সিং এর ফাঁসির দিনকেই শহিদ দিবস রুপে দেশ পালন করে চলেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সেই ভগত সিং এর গুরু কাশীর শচিন্দ্র নাথ সান্যাল আজ বিস্মৃত।
Comments
Post a Comment