ভারতীয় ক্রিকেটে কাশীর অবদান


অবশেষে স্বপ্নপূরণ। অবশেষে আবারও একটা বিশ্বকাপ এল ভারতের ঘরে।রুদ্ধশ্বাস ম্যাচে রক্তচাপ বাড়িয়ে বার্বেডোজে ভারতের পতাকা ওড়াল রোহিত শর্মার দল। সাত রানে জিতে ২০০৭ সালের পরে আবারও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ঘরে তুলল ভারত। সে বার মহেন্দ্র সিংহ ধোনির হাত ধরে ট্রফি এসেছিল। এ বার ট্রফি উঠল রোহিত শর্মার হাতে। কোটি কোটি ভারতীয় ক্রিকেটভক্তের স্বপ্নকে বাস্তবে বদলে দিল রোহিত- বাহিনী। বার্বেডোজের মাঠে লেখা হয়ে গেল এক অমর কাব্য।

এই ক্রিকেট কাব্য এক দিনে লেখা হয়ে নি। লেগেছে দীর্ঘ দিন। ক্রিকেট কাব্যের ভারতীয় আদি ক্রিকেট কবিদের যদি নাম নেতে হয়, তাহলে বারানসীর মহারাজ বিজ্জি’র কথা বলতেই হয়। লেফটেন্যান্ট কর্নেল স্যার বিজয় আনন্দ গজপতি রাজু বিখ্যাত ভারতীয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার, ক্রিকেট প্রশাসক ও রাজনীতিবিদ ছিলেন। সর্বসমক্ষে তিনি বিজ্জি কিংবা বিজিয়ানাগ্রামের মহারাজকুমার নামে পরিচিত ছিলেন। বিজিয়ানাগ্রামের শাসনকর্তা পশুপতি বিজয় রাম গজপতি রাজুর দ্বিতীয় পুত্রসন্তান ছিলেন বিজ্জি। এ কারণেই তার পদবী মহারাজকুমার হয়েছে।

১৯২২ সালে পিতার দেহাবসানের পর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা রাজা হন। বেনারসে পারিবারিক সম্পত্তি দেখাশোনার জন্য বিজ্জি স্থানান্তরিত হন। আজমিরের প্রিন্সেস কলেজে (মেয়ো কলেজ) অধ্যয়ন শেষে ইংল্যান্ডে চলে যান। সেখানে তিনি হেইলিবারি ও ইম্পেরিয়াল সার্ভিস কলেজে পড়াশোনা করেন। টেনিস ও ক্রিকেটে তার দক্ষতা ছিল। উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাবস্থায় মুশতাক আলীকে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে বেনারসে নিয়ে আসেন।


১৯২৬ সালে বিজ্জি ক্রিকেট দল সংগঠিত করে। নিজ প্রাসাদ এলাকায় মাঠের অবকাঠামো নির্মাণে অগ্রসর হন। ভারত ও বাইরে থেকে খেলোয়াড়দের এতে অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৯৩০-৩১ মৌসুমে পূর্ব-নির্ধারিত এমসিসি দলের ভারত সফর রাজনৈতিক কারণে বাতিল করা হলে স্ব-উদ্যোগে ভারত ও সিলন গমন করেন। তিনি দলের অধিনায়কত্ব গ্রহণের জন্য জ্যাক হবস ও হার্বার্ট সাটক্লিফকে অনুরোধ করেন। এ উল্লেখযোগ্য অর্জনটুকু পাঁচবার হবস অস্বীকার করেন। কয়েকবছর পর বিজ্জি লিয়ারি কনস্ট্যান্টাইনকে ভারতে নিয়ে আসেন। মৌসুমে সফর আয়োজন করে বিজ্জি ভারতীয় ক্রিকেটকে ভিত্তি এনে দেন। পাতিয়ালার মহারাজার পর এ সফরটি দ্বিতীয় ছিল। এ পর্যায়ে পাতিয়ালার সাথে ভারতের বড়লাট লর্ড উইলিংডনের সুসম্পর্ক না থকালেও বিজ্জির সাথে সুন্দর সম্পর্ক বিরাজমান ছিল। বড়লাটের সম্মানার্থে দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলা মাঠের নতুন একটি প্যাভিলিয়ন নামাঙ্কিত করেন। ১৯৩৪ সালে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশীপ প্রতিযোগিতা শুরু হয়। তিনি স্বর্ণনির্মিত উইলিংডন ট্রফি দান করার চেষ্টা চালান। তবে পাতিয়ালা তাকে রঞ্জী ট্রফি প্রদানের মাধ্যমে পরাভূত করেন। তার অর্থবিত্ত ও যোগাযোগে দক্ষতার কারণে ভারতীয় ক্রিকেটে ব্যাপক প্রভাববিস্তার করতে সমর্থ হন। ত্রিশের দশকের শুরুতে বোর্ডকে পঞ্চাশ হাজার রূপীসহ ১৯৩২ সালে ইংল্যান্ড সফরে ভারত দলের জন্য চল্লিশ হাজার টাকা দিতে চেয়েছিলেন। এ সফরে তিনি উপ-অধিনায়কের জন্য মনোনীত হন। তবে স্বাস্থ্যের ক্রমাবনতি ও দূর্বলমানের খেলা প্রদর্শনের কারণে স্বীয় নাম প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হন।

লর্ডসে মাইনর কাউন্টিজের বিপক্ষে ভারতের প্রস্তুতিমূলক খেলার ঘটনা চোখে পড়ে। খেলা চলাকালীন লালা অমরনাথের পিঠের আঘাতের কারণে সুশ্রুষার দরকার পড়ে। বিজ্জি তার প্যাড খুলতে সহায়তা করলেও ব্যাট তুলে দেননি। তার পরিবর্তে কোন ব্যাটসম্যানকে নামানো হয়নি। ফলশ্রুতিতে অমরনাথ বিশ্রামের কোন সুযোগ পাননি। দিনশেষে ব্যাট রাখার পর দৃশ্যত রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বিশ্রাম কক্ষে ফিরে তার সরঞ্জামাদি ব্যাগে রাখেন ও পাঞ্জাবী ভাষায় গালিগালাজ করেন। 'আমি জানি দুর্নীতি কি।' বিজ্জি সুযোগ পেয়ে দলীয় ব্যবস্থাপক মেজর জ্যাক ব্রিটেন জোন্সের কাছে অভিযোগ করেন। এরফলে প্রথম টেস্ট শুরুর পূর্বেই সফর থেকে দেশের পথে যাত্রা শুরু করেন অমরনাথ।

বিজ্জি নাইট উপাধি পান। রাজার জন্মদিনের সম্মাননায় বিজ্জিকে রাজা অষ্টম এডওয়ার্ডের তরফে নাইট পদবীতে ভূষিত করা হয়েছিল। একমাত্র সক্রিয় টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে ঐ বছরের জুনে অভিষেক ঘটিয়ে এ সম্মাননা লাভ করেন। এছাড়াও ঐ বছরেরই আগস্ট মাসে সর্বশেষ টেস্টে অংশ নেন তিনি। জুন, ১৯৪৭ সালে বিজ্জি তার নাইটহুড প্রাপ্তির বিষয়ে বড়লাট মাউন্টব্যাটেনকে এক পত্রে ব্যাখ্যা দেন যে, ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের আদর্শ ধরে রাখার জন্য তাকে এ সম্মাননা দেয়া হয়নি।

১৯৪৪ সালে বেনারস বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে সম্মানসূচক ডক্টর অব ল ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯৫৮ সালে তিনি পদ্মভূষণ পদকে ভূষিত হন। 'এ হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়ান ক্রিকেট' শিরোনামীয় গ্রন্থে মিহির বসু লিখেছেন যে, 'ক্রিকেট খেলা আয়োজন করে অষ্টাদশ শতকের স্যার হোরাশিও মান, কিংবা বিংশ শতকের স্যার জুলিয়েন কানের ন্যায় তিনি যথেষ্ট সফলতা লাভ করেছেন। ক্রিকেটে তিনি অন্যতম মর্যাদাবান হতে পারতেন। তবে তিনি নিজেই সেরা ক্রিকেটার হতে চেয়েছিলেন। 'ইংল্যান্ড সফর পরবর্তীকালে দূর্বল অধিনায়কত্ব বিশেষ করে অমরনাথের ঘটনায় অভিযোগের মুখোমুখি হন বিজ্জি। জানুয়ারি, ১৯৩৭ সালে বিউমন্ট কমিটি প্রতিবেদন আকারে জানায় যে, তার অধিনায়কত্ব বিপর্যয়মূলক ছিল। উল্লেখ করা হয় যে, তিনি মাঠের অবস্থান কিংবা বোলিং পরিবর্তনের বিষয়টি বুঝতেন না এবং কখনো নিয়মিত ব্যাটিং অর্ডারের ধার ধারতেন না।

প্রায় দুই দশককাল নির্জন অবস্থায় ছিলেন বিজ্জি। ১৯৫২ সালে বিসিসিআইয়ে সহঃ সভাপতি থাকাবস্থায় লালা অমরনাথকে ভারতের অধিনায়কের দায়িত্বভার প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি ক্রিকেট প্রশাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৭ সময়কালে বিসিসিআইয়ের সভাপতিত্ব করেন তিনি।

উত্তর প্রদেশের ক্রিকেটের সমৃদ্ধি আনয়ণে অগ্রসর হন। কানপুরে টেস্ট ক্রিকেটকে জনপ্রিয় করে তুলেন। তার ঐকান্তিক ইচ্ছার ফসলস্বরূপ ৬১ বছর বয়সে সি. কে. নায়ডু ১৯৫৬-৫৭ মৌসুমে উত্তরপ্রদেশের অধিনায়কত্ব করেন। দক্ষিণ ভারতে ক্রিকেটের উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করেন ও মহীশুর ক্রিকেট সংস্থার পক্ষ থেকে সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। ১৯৪৮-৪৯ মৌসুমে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অনুষ্ঠিত সিরিজে বিজ্জি রেডিও ধারাভাষ্যকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ১৯৫৯ সালে ভারত দলের ইংল্যান্ড সফরে বিবিসির অতিথি ধারাভাষ্যকার ছিলেন তিনি। সচরাচর তিনি ভাষ্যকর্মে সফল ছিলেন না।

কাশিপুরের জমিদারের জ্যেষ্ঠা কন্যার সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন তিনি। ২ ডিসেম্বর, ১৯৬৫ তারিখে নিজের ৬০তম জন্মদিনের পূর্বে বেনারসে (বর্তমানে বারানসিতে) তার দেহাবসান ঘটে। কেদার ঘাট লাগোয়া ঘাটের নাম এই মহান রাজা কেই উৎসর্গ করা হয়েছে।


বারানসীর আরও এক বাঙালি, ক্রিকেট জগতের বড় নাম তারক দাস মুখার্জি; আজীবন টি ডি দাদা নামে পরিচিত। তার সময়ের একজন প্রাক্তন উইকেট-রক্ষক ব্যাটার, টিডি প্রাক্তন রঞ্জি ট্রফি ক্রিকেটার এবং ডেপুটি ডিরেক্টর (ক্রীড়া) নীরু কাপুরের সাথে 1962 সালে এলাহাবাদে একটি আন্তঃজেলা ম্যাচ চলাকালীন দেখা করেছিলেন এবং তারপর থেকে তারা ভাল বন্ধু হয়ে ওঠেন। "এমনকি বারাণসীতে আমার পোস্টিংয়ের সময়, আমরা ক্রিকেট সম্পর্কে অনেক আলোচনা করতাম এবং টিডি সবসময় খেলা সম্পর্কে ইতিবাচক কথা বলত," কাপুর বলেছেন। "তিনি (টিডি) একজন সত্যিকারের ভদ্রলোক ছিলেন এবং একজন ভালো আম্পায়ারও ছিলেন।"

তার আরও এক ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং আম্পায়ার মুকুল ঘোষ বলেন, দাদা বিয়ে করেননি এবং ভদ্রলোকের এই খেলায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, ১৯৫৩ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে দীর্ঘ ৪৩ বছর ধরে আম্পায়ারিং করার রেকর্ড রয়েছে।

১৯৭২ সালে রঞ্জি ট্রফি প্যানেলে স্নাতক হওয়ার আগে টিডি শুধুমাত্র ১৯৬৬ সালে রাজ্য প্যানেল আম্পায়ার হয়েছিলেন। তারপরে, তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি কারণ তিনি ১৯৮২ সালে বিসিসিআই প্যানেলের এলিট গ্রুপে যোগদানকারী উত্তর প্রদেশ থেকে প্রথম আম্পায়ার হয়েছিলেন। টিডি ১৯৭৩ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ২৫টি রঞ্জি ট্রফি ম্যাচে আম্পায়ার ছিলেন, তিনটি দলীপ ট্রফি ম্যাচ, তিনটি উইলস ট্রফি গেম, তিনটি অনূর্ধ্ব-১৯ আন্তর্জাতিক ম্যাচ এবং পাঁচটি মহিলাদের টেস্ট ম্যাচে আম্পায়ারিং করেছিলেন।

ভারতের ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের প্যানেলে উত্তরপ্রদেশের প্রথম আম্পায়ার, তারক দাস মুখার্জি বারাণসীতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, ৮৯ বছর বয়সী টি ডি দাদা মৃত্যুর কয়েক মাস আগে মাথায় আঘাত পেয়েছিলেন।

ভারতীয় ক্রিকেটে বারানসীর অবদান কে ভলা কঠিন। 

Comments

Popular posts from this blog

আচার্য ভরত প্রস্তাবিত অভিনয়রীতি

কাশীর বাঙালী টোলার দ্বীতিয় পাতালেশ্বর