দশ শতাব্দীরও অধিক পুরাতন কাশীর নৃসিংহ লীলা

নৃসিংহলীলা
জয়দেব দাস, কাশী 
মাতৃ জঠরে থাকাকালীন কয়াধুর মাধ্যমে প্রহ্লাদ নারদের হরিগুণগানে বিভোর থাকতেন৷ জন্মলাভের পর বাল্যকাল অবধি তিনি নারদের কাছে বিদ্যালাভও করেছিলেন৷ এর ফলে প্রহ্লাদ শ্রীবিষ্ণুর এক প্রিয় ভক্ত হয়ে ওঠেন৷ অপরদিকে তার পিতার ভগবানের প্রতি অনীহা ও আধ্যাত্মিকতার প্রতি অনাস্থার দরুণ প্রহ্লাদ বারবার নিজ পিতার থেকে সাবধানবাণী পান৷ একাধিকবার এরূপ সতর্কতা উপেক্ষা করেও বিষ্ণুর প্রতি তাঁর বিশ্বাস একটুও কম হয়নি৷ ফলস্বরূপ হিরণ্যকশিপু পুত্রকে হত্যা করতে উদ্যত হলেও বিষ্ণুর কৃপায় বারবার বেঁচে যায় প্রহ্লাদ৷ তাঁর হাতি দ্বারা পদদলিত করার পরিকল্পনাও বিফলে যায়৷ পরে দৈত্যরাজ নিজ পুত্রকে সর্পসংকুল কক্ষে আবদ্ধ করলে সর্পকুল প্রহ্লাদের জন্য পালঙ্ক নির্মাণ করে দৈত্যরাজের পরিকল্পনা নস্যাৎ করে। এসবের পরেও প্রহ্লাদকে দৈত্যচেরীগণ নদীতে নিক্ষেপ করলে বিষ্ণুই তাকে উদ্ধার করেন৷ হিরণ্যকশিপুর ভগিনী হোলিকা বরপ্রাপ্ত ছিলেন যে অগ্নি তাকে ভষ্ম করতে পারবে না৷ হিরণ্যকশিপুর পরিকল্পনায় হোলিকা জ্বলন্ত চিতার ওপর নিজ ভ্রাতুষ্পুত্রকে কোলে নিয়ে ঝাঁপ দেয়৷ প্রহ্লাদের প্রার্থনায় ও বিষ্ণুর ছলনার দ্বারা ঐ আগুনে হোলিকাদহন ঘটলেও প্রহ্লাদ প্রাণে বেঁচে যায়৷ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে এই ঘটনাটিই হোলিকা দহন বা বাংলায় ন্যাড়াপোড়া নামে পরিচিত৷ প্রহ্লাদের প্রতি হিরণ্যকশিপুর এইরূপ আচরণের পর বিষ্ণু অর্ধনর অর্ধসিংহ তথা নৃসিংহ অবতার গ্রহণ করে দৈত্যপুরীর স্তম্ভ চিড়ে প্রকাশিত হন ও সায়ংকালে ঘরের চৌকাঠে নিজের উরূর ওপর রেখে নৃসিংহ ধারালো নখর দিয়ে হিরণ্যকশিপুর পেট চিড়ে তাকে বধ করেন৷ এই সব ঘটনাবলী কাশীর প্রহ্লাদ ঘাটে পাঁচ দিন ব্যাপী লীলা অনুষ্ঠানে মঞ্চস্থ হতে দেখা যায়। 
কাশী শিবের নগরী রূপেই বিশ্ব পরিচিত। কিন্তু আমরা যদি লীলাগুলির ডীকে তাকাই, তবে সবই বিষ্ণুর অবতারের ওপর ভিত্তি কোরে গড়া। রামলীলা, কৃষ্ণ লীলা অথবা নৃসিংহ লীলা। ড ভানুশঙ্কর মেহতার মতে-কাশীর গুরুত্বপূর্ণ লীলাগুলি থেকে জানা যায় যে, কাশীতে তুলসীর সময় থেকেই রামলীলা ছাড়াও কৃষ্ণলীলা (ব্রজের রাসলীলা থেকে আলাদা), বামনলীলা, নৃসিংহলীলা, দশাবতার এবং ফাগলীলা, ধ্রুবলীলা (বর্তমানে বিলুপ্ত) হয়ে আসছে। 
কাশীর নৃসিংহ লীলা শতাব্দী প্রাচীন। নিশা একাদশীর সম্মানে, মধ্যরাতে, কাশীর গঙ্গা কিছু সময়ের জন্য দুধসাগরে পরিণত হয়ে। প্রহ্লাদ ঘাটের সামনে গঙ্গাধরের বিশাল বজরাটিকে শেষনাগের রূপ দেওয়া হয়েছিল। ভগবান শ্রী হরি বিষ্ণু ঋষিদের কাছে আবির্ভূত হন। ঋষিদের পীড়াপীড়িতে তিনি বললেন, তোমরা সবাই শান্ত হও। আমি অবতীর্ণ হব এবং তোমরা সকলে অসুর থেকে রক্ষা পাবে।
এই সবই ঘটেছে শ্রী নৃসিংহ লীলার প্রথম পর্বে যা হাজার বছরেরও বেশি পুরনো। ক্ষীরসাগরে ঋষিদের যাত্রার ঘটনার মধ্য দিয়ে শনিবার রাতে লীলা শুরু হয়। ঋষিরা শ্রী হরির দর্শনে পৌঁছে গেলেন। শ্রী নৃসিংহ লীলার প্রথম দিনে শনিবার রাতে প্রহ্লাদ ঘাটে ক্ষীর সাগর যাত্রা মঞ্চস্থ হয়। দারোয়ান জয়-বিজয় ঢুকতে বাধা দেয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ঋষিরা উভয় ভাইকে রাক্ষস হওয়ার অভিশাপ দেন। ঋষিদের অভিশাপের কারণে জয়-বিজয় হিরণ্যক্ষ ও হিরণ্যকশিপু রূপে জন্মগ্রহণ করেন। তাদের আতঙ্কে মানব জাতি আতঙ্কিত হয়েছিল। তখন আকাশ থেকে শ্রী হরির আওয়াজ হল। জানালেন শিগগিরই তিনি নরসিংহের অবতার নেবেন। সবশেষে লীলা কমিটির চেয়ারম্যান অভিজিৎ ভরদ্বাজের আরতির মাধ্যমে প্রথম দিনের লীলা শেষ হয়। ভগবান বিষ্ণুর রূপটি আনমোল ত্রিবেদী দ্বারা, লক্ষ্মীর রূপটি দেবরাজ ত্রিপাঠী দ্বারা, বুদ্ধ সাহনি এবং পাপ্পু সাহনির দ্বারা জয়-বিজয়ের রূপ। লীলা ব্যাস (নির্দেশক) ছিলেন আচার্য শশাঙ্ক ত্রিপাঠী।
লীলার দ্বিতীয় দিন প্রহ্লাদ ঘাটে শ্রী নৃসিংহ লীলায়ে ভক্ত প্রহ্লাদের জন্মের কাহিনী সম্পাদিত হয়। এর আগে বরাহ অবতারের লীলা এবং হিরণ্যক্ষের বধ হয়েছিল। রাত ১০টায় শুরু হওয়া লীলা দেখতে ঘাটে উপস্থিত ছিলেন বিপুল সংখ্যক স্থানীয় লীলা প্রেমীরা। ভক্ত প্রহ্লাদের আরতির মাধ্যমে লীলা শেষ করা হয়। লীলার সময় ভক্তরা প্রহ্লাদের জন্য উল্লাস করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত কমিটির সভাপতি অভিজিৎ ভরদ্বাজ সকল লীলাপ্রেমীদের ভোট দিতে সচেতন করেন।
শ্রী নৃসিংহ লীলার তৃতীয় নিশায় ভক্ত প্রহ্লাদের দীক্ষা লীলা হয়। দমকা হাওয়ার মধ্যে লীলা সম্পন্ন হয়। রাত সাড়ে বারোটার দিকে গঙ্গার তীরে প্রহ্লাদ ঘাটে লীলা শুরু হয়। স্থানীয় লোকজন বিভিন্ন ভূমিকা পালন করে গুরুকুলের দৃশ্য উপস্থাপন করেন। গুরুকুলে বেদ পাঠের ক্রম শুরু হওয়ার আগেই প্রহ্লাদ সেখানে উপস্থিত অন্যান্য শিষ্যদের সাথে হরিনাম সংকীর্তন শুরু করেন। সংকীর্তনে এত আবেগ ছিল যে তাঁর গুরু নিজেও সংকীর্তন করতে লাগলেন। লীলার দ্বিতীয় পর্বে হিরণ্যকশিপুর নৃশংসতার দৃশ্য জীবন্ত হয়ে উঠেছিল। যুবক প্রহ্লাদের উপর প্রচণ্ড আক্রমন দেখে মানুষের হৃদয় ভেঙে পড়ল কিন্তু হিরণ্যকশ্যপ তার জেদের উপর অনড় রইলেন। সে বারবার বলেছিল যে তাকে ভগবান হিসাবে পূজা করা উচিত, তবে ভক্ত প্রহ্লাদ শ্রী হরি ছাড়া অন্য কাউকে পূজা করবেন বলে প্রস্তুত হচ্ছিলেন না। প্রহ্লাদকে নানাভাবে অত্যাচার করার পর হিরণ্যকশ্যপ ক্লান্ত হয়ে রাতে বিশ্রামে চলে যান। শেষ হয় তৃতীয় দিনের খেলা। শ্রী নৃসিংহ অবতারের মূল লীলা সম্পন্ন হয়ে ২১ মে মধ্যরাতে। প্রহ্লাদের প্রতি হিরণ্যকশিপুর এইরূপ আচরণের পর বিষ্ণু অর্ধনর অর্ধসিংহ তথা নৃসিংহ অবতার গ্রহণ করে দৈত্যপুরীর স্তম্ভ চিড়ে প্রকাশিত হন ও সায়ংকালে ঘরের চৌকাঠে নিজের উরূর ওপর রেখে নৃসিংহ ধারালো নখর দিয়ে হিরণ্যকশিপুর পেট চিড়ে তাকে বধ করেন৷

Comments

Popular posts from this blog

আচার্য ভরত প্রস্তাবিত অভিনয়রীতি

কাশীর বাঙালী টোলার দ্বীতিয় পাতালেশ্বর