বাদল বাবুর কাশীলাভ

না বাদল বাবুর কাশী লাভ হয়নি, কিন্তু তাঁর কৃতি এখানে বার বার আলোচিত - মঞ্চিত বারংবার হয়েছে, হয়ে চলেছে। এটাই তাঁর কাশী লাভ মনে করা যেতেই পারে।

গোপীনাথ কবিরাজ মহাশয় এর জ্ঞানগঞ্জ বই টি আমার কাছে অনেক দিন দুর্বোধ্য ছিল। বিশেষ করে একটা মানুষ নিজের দেহ এক জায়গায় রেখে, সারা পৃথিবী কি করে বিচরণ করতে পারে ! আমার কাছে এটাই ছিল পরম আশ্চর্যের।

এই আশ্চর্যের সমন কিছুটা বাদল বাবুই আমার জীবনে করেছেন, এ কথা বলতে পারি। বাদল বাবু কাশী তে নিজে না এলেও তাঁর কৃতি সারা পৃথিবীর মত কাশী তেও সমাদৃত হয়েছে। এখানকার নাট্য বিদ দের ভাবিয়েছে, মঞ্চায়ন করতে বাধ্য করেছে।
 
আজ তাঁর জন্মদিন। আমি নিজের কথা আরম্ভ করছি, বাদল বাবু ও তাঁর কৃতি আমার ঝুলিতে যখন যে ভাবে এসেছেন, সেখান থেকেই। আজ এটাই আমার তাঁর প্রতি বিনীত শ্রদ্ধা জ্ঞাপন। 

গন্ডি 
১৯৯৭, কাশীর বাঙালি টোলা অঞ্চলের তারা বাড়ি। এই তারা বাড়ি (মন্দির) রাণী ভবানীর অবদান ও কীর্তি, কাশীর মানুষের মনে রাখতে বাধ্য করে। সেই তারা বাড়ির বিরাট উঠোনে বাদল বাবুর নাটক গন্ডির মহড়া চলছে। তখন ভরা শীত। হাড় কাঁপানো শীতের মাঝে যদি বর্ষা হয়ে তাহলে আর কথাই নেই। আমাদের মহড়ায় সেই দিন চোপ মুড়ি উৎসব। গন্ডি নির্ধারিত দিনেই মঞ্চায়ন হল। তবে প্রসেনিয়ামে নয় থার্ড থিয়েটার আঙ্গিকেই। 

পাগলা ঘোড়া (২০০০)
এই নাটক আমায় আমার বঙ্গীয় নাট্য সমাজের গন্ডি অতিক্রম করতে সাহায্য করেছে। ১৯৯৫ থেকে ২০০০ পর্যন্ত আমি পুরো দমে কাশীর বঙ্গ নাট্যের বিভিন্ন দলে বিচরণ করে একটা পরিচিতি করে ফেলেছি। তারই পুরস্কার রূপে পাগলা ঘোড়া র মত নাটক আমার লাভ বলা যেতে পারে। গন্ডির নির্দেশক শ্রী পার্থ বেনার্জী মহাশয় আমায় নিজের সঙ্গে সহ নির্দেশক রূপে কাশীর পুরাতন হিন্দী নাট্য দল শ্রী নগরী নাটক মন্ডলী নিয়ে যান। যেখানে তার নির্দেশনায় নির্মিত হচ্ছে বাদল বাবুর পাগলা ঘোড়া।
সুমন পাঠক, রাজেশ্বর ত্রিপাঠী, ইয়াসিন খান, পার্থ চক্রবর্তী ও ড. পরিতোষ ভট্টাচার্যর মত হিন্দী নাটকে সুঅভিনেতারা। সেই সময় আমি তাদের কি নির্দেশনা দেবো এটাই ভেবে ঘেমে নেয়ে একাকার হতাম। নাটক মঞ্চায়ন হলো, তাদের পরিশ্রম আমার সুনাম হিন্দী নাট্য জগতে হল।

কবি কাহিনী 
১৯৪৮ এ গঠিত লালিত চক্র কাশীর পুরাতন বাংলা নাট্য সংস্থান। ১৯৯৭ থেকে আমিও এখানে নিয়মিত ভাবে নাটকে মঞ্চে বা নেপথ্যের সঙ্গে যুক্ত। ২০০১ থেকে বছরে দুটো পূর্ণ দৈর্ঘ্যের নাটক করা হবে তাদের সিদ্ধান্ত। সেই পরিকল্পনায় অন্ধকারের নিচে সূর্য্য আগেই করা হয়েছে। এবার বাদল বাবুর কবি কাহিনী। আমি মুখ্যভূমিকে।  

বল্লভ পুরের রূপ কথা
২০০৪, আমার জীবনের সব থেকে পরিশ্রমী নাটক। হবেই না বা কেন, ডবল চরিত্র যে। চারশ বছরের ভুত আর এক জন দেন্টিস। তার ওপর ক্রমাগত সংস্কৃত শ্লোক আওড়ানো। তখন ললিত চক্র কাশী ছাড়া, গরাখপুর, এলাহাবাদ আজকের প্রয়োগরাজ, লখনৌ নাটক এর আমন্ত্রণে যোগ দেওয়া শুরু করেছে। 

বাদল বাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎকার 
২০০৭, আমার নাট্য স্নাতকের দ্বিতীয় বর্ষ। প্রাকটিকাল এর জন্য শ্রদ্ধেয় ঊষা গাঙ্গুলির অনুগত। রংকর্মী প্রযোজিত ও ঊষা গাঙ্গুলির নির্দেশিত খেলা গাড়ি, মাইয়ত, অন্তর যাত্রা, কোর্ট মার্শাল, কাশীনামা, রুদালি মত তাবড় তাবড় নাটকের নেপথ্যে বা মঞ্চে থেকে নাটকের খুঁটি নাটি কে গো গ্রাসে গিলছি। সেই মুহূর্তে, এক দিন বাদল বাবুর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হলো। কাশী বিদ্যাপীঠ এর নাট্য বিভাগের আচার্য্য ড. গৌতম চট্টোপাধ্যায় মনে আমার নাটকের অধ্যাপক আমায় ফোন করেন যে, এক দিন বাদল বাবুর বাড়ি আমায় যেতে হবে। বাদল বাবু নিজের সদ্য প্রকাশিত বই পুরোনো কাসুন্দি ও অন্যান্য বই আমায় দেবেন। সেই বই আমি সঙ্গে করে বেনারস নিয়ে ফিরব। বাদল বাবুর সঙ্গের আলাপ এক অমূল্য সম্পদ আমার জীবনে।

সারা রাত্রি 
২০০৮, নাট্য স্নাতক পূর্ণ হয়েছে। নগরী নাটক মন্ডলীর নাট্য উৎসব আমন্ত্রণ পেয়েছি, কি সৌভাগ্য। কিন্তু কোন নাটক করবো বুঝে উঠতে অক্ষম। রঙ্গপ্রবাহ দলে সদস্য কম। প্রথমে সাত্রের no exit নামাবো নির্ধারিত করি, পরক্ষনেই মত পাল্টে বাদল বাবুর সারা রাত্রি করার কথা আয়োজন সমিতি কে জানাই। হিন্দী স্ক্রিপ্ট শ্রধ্যেয়া প্রতিভা আগরওয়াল থেকে পেয়ে যাই। নাট্য মঞ্চায়নের অনুমতি চাওয়া জন্য বাদল বাবু কে ফোন করি। রয়েলটির কথা বলেন। আমার গা হাত পা ঠাণ্ডা। একটু থেমেই ফোনের ওপার থেকে একটা হাঁসির স্বর কানে আসে। তার সঙ্গেই কুলদীপ, উমেশ, দিব্য - র প্রাণ ফেরে; যারা এই নাটকে অভিনয় করবে ঠিক করা হয়েছে। বাদল বাবু সে দিন যা শিক্ষা দিয়ে ছিলেন তা সারা জীবন কাজে লাগবে।

সুধীন্দ্র, বাদল এবং ইন্দ্রজিৎ
২০১৫, এত দিন যে বাদল বাবু এবং তার নাটক নিয়ে আমার যা ধারণা হয়েছে তা পরীক্ষণ করার ইচ্ছে নিয়ে, এক নাটক নির্মাণে ব্রতী হই। কিন্তু, বাদল বাবু আর আমাদের মাঝে নেই। না থাকলে কি হবে আমরা তাকে ছাড়ছি না। বাদল বাবুর ৯০ তম জন্ম বর্ষেই তাঁর এবং ইন্দ্রজিৎ নাটকের ৫০ বর্ষ পূর্তি র সময়, শ্রী অনিল রঞ্জন ভৌমিক এলাহাবাদে এক বিরাট আয়োজন করে। আমিও আমন্ত্রিত। নাটক না হলে যাবো কি করে? অনিল দা আবার এবং ইন্দ্রজিৎ মঞ্চায়নের পক্ষে। আমি ঠিক করি বাদল বাবুর নয়, নিজের মত করে এবং ইন্দ্রজিৎ করতে হবে। নাটক লিখি সুধীন্দ্র, বাদল এবং। এটা নাটক নয় বলা যেতে পারে ডক্যু ড্রামার মত কিছু। যেখানে আছে সুধীন্দ্র - এর বাদল রূপে বিবর্তন। আবার বদলের জীবনে এবং ইন্দ্রজিৎ নামক আদর্শের প্রতিফলন। প্রথম মঞ্চায়ন রাজা জয় নারায়ণ ঘোষাল দ্বারা নির্মিত গুরুধাম মন্দির প্রাঙ্গণে। না আমরা এলাহাবাদে এই নাটক করে উঠতে পারি নি। 

২০১৬, বাদল বাবু একাত্তরের এক ঘটনার দরুন নিজের নাট্য রীতি নীতি বদলে নেন। বলা যায় অঙ্গন মঞ্চের দিকে এখন থেকেই তার ভাবনার প্রতিফলন। আজকের একদেমী অফ ফাইন আর্টস এর তেতলায় সে দিন যে নাটক বাদল বাবু করেছিলেন তা খাতায় নয় কেবল তার মস্তিষ্কই লেখা রয় গেছিল, এক সাক্ষাৎকারে সেই নাটকের বিবরণ দিয়ে যান। সেই বিবরণের বিত্তি তেই আমি নাটক নির্মাণে আগ্রহী হই, কোলকাতার কিছু উৎসাহী যুবক যুবতীর নিয়ে। নাটকের মহড়া আরম্ভ হয়ে মৌলালির কাছে। রঙ্গকর্মির বন্ধু প্লাবন বসু নতুন দল গড়েছে রঙ্গশিল্পী, সেই দল এই নাটকের ব্যয়ভার তোলার আশ্বাস যোগায়। কিন্তু, শেষ মেষ মঞ্চায়ন হয় নি।

২০২০, সিনেমা ও নাটক বিষয় স্নাতকোত্তর করবো। সুযোগ পেলাম মহাত্মা গান্ধী আন্তর্জাতিক হিন্দী বিশ্ববিদ্যালয় (ওয়ার্ধা, মহারাষ্ট্র) পড়ার। এক দিন আমার হোস্টেল রুমে স্বরাজ ঠাকুর এলো, বললে তাকে এক নাটক নির্দেশনা করতে হবে। সেই নাটক নামতে এক সিনিয়র কে সঙ্গে নিতে হবে। তাই সে আমার সাহায্য চায়। নাটক বেছেছে বাদল বাবুর পাগলা ঘোড়া। নাটক নামলো, প্রশংসিত হল। আমি মনে মনে বাদল বাবু কে প্রণাম জানলাম।

২০১৪, বারো মাসে, বারোজন ভারতীয় নাট্য ঋষিদের উৎসর্গ করে এক ক্যালেন্ডার নির্মাণ করি। সঙ্গে লাগান সেই ক্যালেন্ডার এরই ছবি।

Comments

Popular posts from this blog

আচার্য ভরত প্রস্তাবিত অভিনয়রীতি

কাশীর বাঙালী টোলার দ্বীতিয় পাতালেশ্বর